নিয়মিত শরীরচর্চা, স্বাস্থ্যসম্মত ভাবেই দিনযাপন— তবুও হৃদ্যন্ত্রকে কি আগলে রাখা যাচ্ছে? করোনা পরবর্তী অধ্যায়ে হৃদ্রোগে আক্রান্তের অহরহ ঘটনায় উদ্বেগ বাড়াচ্ছে এই প্রশ্ন। কী ভাবে এই মারণরোগের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে, তা নিয়ে নানা পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। তবুও হৃদ্রোগের প্রকোপ যে ঠেকানো যাচ্ছে না, তা আরও এক মৃত্যুর ঘটনা দেখিয়ে দিল।
নাম ল্যারিসা বোর্হেস। ব্রাজিলের প্রভাবী। সমাজমাধ্যমে তাঁর জনপ্রিয়তাও রয়েছে। মাত্র ৩৩ বছর বয়সি এই মহিলা হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে সম্প্রতি প্রাণ হারিয়েছেন।
গত সোমবার ‘ডবল কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’-এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ল্যারিসার। ‘নিউ ইয়র্ক পোস্ট’-এর প্রতিবেদনে এই খবর প্রকাশ্যে আসতেই হৃদ্রোগ নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ ছড়িয়েছে জনমানসে।
নিজের ফিটনেস নিয়ে সচেতন ছিলেন ল্যারিসা। তার পরও কী ভাবে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হলেন তিনি? এই প্রশ্নই ভাবাচ্ছে সকলকে। এক সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন ল্যারিসা। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।
কম বয়সে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু এখন প্রায় রোজকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক’দিন আগেই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন কুস্তিগির ব্রে ওয়াট।
গত ২৪ অগস্ট ডব্লিউডব্লিউই খ্যাত এই তারকার মৃত্যু হয়। বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৬। আচমকা হৃদ্রোগে আক্রান্ত, আর তার পরই কয়েক মুহূর্তে সব শেষ— এমন ঘটনার তালিকা বেশ লম্বা।
গত জুন মাসের ঘটনা। যিনি হৃদ্রোগের চিকিৎসক, সেই তিনিই কিনা হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন! এমন ঘটনাই ঘটেছে গুজরাতের জামনগরে। হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করেন চিকিৎসক গৌরব গান্ধী। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু পথেই মৃত্যু হয় তাঁর।
১৬ হাজারেরও বেশি হার্টের রোগীকে সুস্থ করে বাড়ি ফিরিয়েছেন গৌরব। অথচ হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁরই প্রাণ গেল। বয়স হয়েছিল মাত্র ৪১।
জিমে কসরত করতে গিয়ে হৃদ্রোগে আক্রান্তের ঘটনায় এখন নতুন নয়। জুলাই মাসে তেমনই এক ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছিল। জিমে শরীরচর্চার সময় হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদের ২৬ বছরের কপিলের।
রাখিপূর্ণিমার দিন হঠাৎ হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে এক যুবকের। ঘটনাটি তেলঙ্গানার পেডাপল্লি জেলার।
ব্যাডমিন্টন কোর্টে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। গত জুন মাসে তেলঙ্গানার ঘটনা। জগতিয়াল শহরের একটি ক্লাবে ব্যাডমিন্টন খেলছিলেন বুসা বেঙ্কটরাজা গঙ্গারাম (৫৩)। সে সময় কোর্টেই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন তিনি। কৃত্রিম উপায়ে তাঁর শ্বাস চলাচলের ব্যবস্থা করা হলেও তাঁকে বাঁচানো যায়নি। এর আগেও ব্যাডমিন্টন কোর্টে প্রাণ কেড়েছে হৃদ্রোগ।
সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরিতে একটি সিনেমা হলে ঢোকার সময় হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে ৩২ বছর বয়সি এক যুবকের মৃত্যু হয় বলে দাবি।
হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা অহরহ ঘটছে। উত্তরপ্রদেশে রাস অনুষ্ঠানে কীর্তন করার সময়ে হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা গিয়েছিলেন ৫১ বছর বয়সি এখন কীর্তনিয়া। গত ২৫ নভেম্বর বারাণসীতে একটি বিয়েবাড়িতে নাচ করার সময় আচমকা মৃত্যু হয় ৪০ বছর বয়সি এক ব্যক্তির। তিনিও হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বলে জানান চিকিৎসকরা।
মধ্যপ্রদেশে বাস চালাতে চালাতেই আচমকা হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন চালক। স্টিয়ারিংয়ের উপর ঢলে পড়েন তিনি। নিয়ন্ত্রণহীন বাস তার পর সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা একের পর এক গাড়িতে ধাক্কা মারে। এই ঘটনায় মৃত্যু হয় এক পথচারীর, আহত হন একাধিক। কাটনির সাই মন্দিরে পুজো দিতে গিয়ে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় রাজেশ মেহানি নামে এক ব্যক্তির। মধ্যপ্রদেশের সেওনি জেলার বাখারি গ্রামে বিয়েবাড়িতে গানের তালে নাচতে নাচতেই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় এক বৃদ্ধার।
শুধুমাত্র যুবক-যুবতীরাই নন, কিশোর-কিশোরীরাও আজকাল হৃদ্রোগের শিকার হচ্ছেন। কর্নাটকের টুমাকুরু তালুকে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে দশম শ্রেণির এক ছাত্রের মৃত্যু হয়। গুজরাতের রাজকোটে স্কুলের মধ্যে একই কারণে মৃত্যু হয় এক কিশোরীর।
এ তো গেল আমজনতার কথা। এ বার দেখে নিন, হৃদ্রোগের কারণে কত তারকার প্রাণ অকালে ঝরে গিয়েছে। এই তালিকায় প্রথমেই যাঁর নাম আসে, তিনি সিদ্ধার্থ শুক্ল।
২০২১ সালের ২ সেপ্টেম্বর হিন্দি টেলি দুনিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় মুখ সিদ্ধার্থ শুক্লর আকস্মিক প্রয়াণ নাড়িয়ে দিয়েছিল সকলকে। চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়েই মৃত্যু হয়েছে সিদ্ধার্থের। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৪০। নিয়মিত শরীরচর্চা করতেন সিদ্ধার্থ। তার পরও তাঁর হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর ঘিরে উদ্বেগ ছড়ায়।
জিম করার সময়ে আচমকা হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ৪৬ বছর বয়সি অভিনেতা সিদ্ধান্ত সূর্যবংশীর। এর আগে জিম করতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছিল কৌতুকশিল্পী রাজু শ্রীবাস্তবের।
গত বছরের ৩১ মে-র কথা। সে দিন কলকাতার নজরুল মঞ্চে শো করতে এসেছিলেন জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী কেকে। গান গাইতে গাইতে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে মারা যান কেকে। যে মৃত্যু সকলকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।
হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে প্রাণ ঝরেছে আরও এক জনপ্রিয় তারকার। হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন কন্নড় ছবির দুনিয়ায় পরিচিত মুখ পুনীত রাজকুমার। রাজু শ্রীবাস্তবের মতো পুনীতও জিমে শরীরচর্চা করতে করতে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
গত জানুয়ারি মাসে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ‘একেন’ চরিত্রের স্রষ্টা সুজন দাশগুপ্তের। দক্ষিণ কলকাতার বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় ৮০ বছর বয়সি ওই লেখকের দেহ। সার্ভে পার্ক থানা এলাকার এক বহুতলে থাকতেন সুজন। তাঁর ফ্ল্যাটে শোয়ার ঘরের মেঝেতে শৌচাগারের পাশে পড়ে ছিল দেহ।
হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়েছেন আরও অনেক তারকা। তবে বর্তমানে তাঁরা সুস্থ রয়েছে। নিয়মিত যোগাভ্যাস করার পরও হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন প্রাক্তন ব্রাহ্মাণ্ড সুন্দরী তথা বলিউড অভিনেত্রী সুস্মিতা সেন। তাঁর অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি করানো হয়।
তালিকায় রয়েছেন দেশের প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও। ২০২১ সালে বিসিসিআই সভাপতির বাঁ দিকের ধমনীতে দু’টি ব্লকেজ ছিল। বসানো হয় স্টেন্ট। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করানো হয়। তবে এখন সৌরভ সুস্থই রয়েছেন।
কিন্তু কেন এত বাড়ছে হৃদ্রোগের প্রকোপ? একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ওজন এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকলেও শৈশবে খেলা এবং শরীরচর্চার অভাব বড় বয়সে হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। খুদেরা এখন মাঠেঘাটে খেলতে যাওয়ার পরিবর্তে বাড়িতে ভিডিয়ো গেম খেলতে বেশি অভ্যস্ত। শিশুদের ‘স্ক্রিন টাইম’ অর্থাৎ, ফোন, টিভি, ল্যাপটপের সামনে থাকার সময় যত বাড়ছে, বড় হয়ে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও ততটাই বাড়ছে বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা। তাঁদের মতে, ভবিষ্যতে ফিট থাকতে হলে, হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমাতে হলে, ছেলেবেলা থেকেই যাপনে বদল আনতে হবে। ছোট থেকেই খেলা, শরীরচর্চা করে দিনের বেশির ভাগ সময় সচল থাকতে হবে।
চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, হার্ট অ্যাটাকের কিছু পূর্ব লক্ষণ দেখা দেয়। চিকিৎসকদের মতে, বুকের বাঁ দিকে ব্যথা তো বটেই, অনেক সময়ে গোটা বুক জুড়েই চাপ ও অস্বস্তি অনুভব হলেও তা হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ। কখনও কখনও বুকের পেশিতেও টান পড়ে। সঙ্গে শ্বাসকষ্টের সমস্যাও দেখা যায়। এমনটা টের পেলে, কায়িক পরিশ্রম হয় এমন কাজ না করাই ভাল।