ফুটবল বিশ্বকাপের একই উঠোনে থাকছিলেন গত ২০ দিন ধরে। কিন্তু এখনও দেখা হয়নি দুই সতীর্থ লিওনেল মেসি আর নেমারের।
ফুটবলের সেই দুই বিরাটায়তন বিগ্রহ এ বার মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষায়। মাঝে শুধু একটি ম্যাচের দূরত্ব। যে আড়াল সরবে যদি একই সঙ্গে হলুদের ছন্দে চোখ ধাঁধায় ক্রোয়েশিয়ার, আর ফুটবল ‘ঈশ্বরের’ জাদুতে ফিকে হয় টিউলিপের কমলা রং।
কিন্তু সেই সম্ভাবনা কি সত্যি হবে? দুই তারকার ভক্তরা বলছেন, আটকানো মুশকিল। ইতিহাস বলছে, বেশি দিন একে অপরের থেকে দূরে থাকতে পারেন না দুই তারকা। মেসি যেখানে, নেমার সেখানেই। আবার এর উল্টোটাও ঘটেনি তা নয়।
গত ৯ বছরের সম্পর্ক নিয়ে খোদ নেমারই একবার বলেছিলেন, আমি মেসির সঙ্গে যত সময় কাটাই, নিজের পরিবারকেও দিতে পারি না।
কিন্তু সে তো ফুটবল মাঠের কথা। ফুটবল ম্যাচ যখন থাকে না দু’জনের পরিবারকেও এক সঙ্গে ছুটি কাটাতে দেখা গিয়েছে বহু বার।
শুরুটা অবশ্য ২০১৩ সালে। সেই বছরটা বার্সেলোনার কাছে একটা উল্লেখযোগ্য বছর। সে বছরই পুরনো ফুটবল ক্লাব স্যান্টোস ছেড়ে বার্সায় যোগ দিয়েছিলেন নেমার।
নেমার তখন উঠতি তারকা। হাওয়ায় উড়ে গোল করেন। কম বয়স। দারুণ এনার্জি। সাড়ে চার বছরের বড় মেসির ততদিনে বার্সায় ১৩ বছর খেলা হয়ে গিয়েছে। বার্সার তারকা তিনি। নিজের দেশ আর্জেন্টিনার হয়ে চুটিয়ে খেলছেন। মারাদোনার উত্তরসূরি হিসাবে নাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। বার্সাতেই দুই ভিন্ন এবং জনপ্রিয় সংস্কৃতির দুই ফুটবলারের সহ-যাত্রা শুরু।
নেমার যখন বার্সায় যোগ দিলেন, অনেকেই ভেবেছিলেন মেসির সঙ্গে ব্রাজিলীয় ফুটবল তারকার জোর টক্কর হবে। কিন্তু বাস্তবে হয় উল্টোটাই। আর্জেন্টিনীয় ফুটবল শিল্পী কাছে টেনে নেন নেমারকে। উরুগুয়ের সুয়ারেজকে সঙ্গে নিয়ে তৈরি হয় বার্সেলোনার দুর্ভেদ্য ত্রয়ী।
কিন্তু মেসির ছায়া দীর্ঘতর হতে শুরু করে ক্রমশ। সেই ছায়ায় ঢাকা পড়তে শুরু করেন নেমাররা। অন্তত নেমার নিজে হয়তো তেমনই মনে করছিলেন। বার্সা ছেড়ে, সতীর্থ মেসেকে ছেড়ে এই সময়েই নেমার চলে যান প্যারিস সঁ জরমঁ (পিএসজি)-তে।
কিন্তু তার পরও বেশি দিন দূরে রাখা যায়নি দু’জনকে। ২০১৭ সালে বার্সা ছাড়েন নেমার। ২০২১-এ বার্সার সঙ্গে ২১ বছরের সম্পর্ক চুকিয়ে দেন মেসিও। যোগ দেন পিএসজি-তে। এ বার মেসিকে স্বাগত জানান নেমার।
বস্তুত, দু’জনের এই রসায়নকে সামনে রেখেই মেসি-নেমারের এই এক মাঠে-এক দলে-এক জার্সিতে খেলার প্রবণতাকে ‘ব্রোম্যান্স’ নাম দেন তাঁদের ভক্তরা।
‘ব্রোম্যান্স’ মানে যেখানে দুই বন্ধু বন্ধুত্বের সীমা ছাড়িয়ে ভ্রাতৃত্ব এবং সেই ভ্রাতৃত্বে প্রেমিকার থেকেও বেশি স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পান।
পুরনো সেই ইতিহাস ঘেঁটেই ভক্তরা বলছেন ক্রোয়েশিয়া আর নেদারল্যান্ডস এই সম্পর্কে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। স্কিল বা ফুটবল খেলার দক্ষতা যা-ই হোক, দুই ‘ভাই’ তাদের কপাল জোরেই মঙ্গলবার এক হবেন এক মাঠে। খেলবেন এক সঙ্গে।
ভক্তদের দাবি, এত কাছাকাছি থেকে মুখোমুখি না হয়ে ফিরে যেতে পারেন না দুই ‘ভাই’। কপালের ফেরেই এক মাঠে খেলার কথা দু’জনের।
তবে এক সঙ্গে খেললেও ওই ম্যাচে দুই ভাই মুখোমুখি হবেন প্রতিপক্ষ হিসাবে। প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে। দেশের সম্মান রক্ষার লড়াইয়ে নামবেন দু’জনে।
ভক্তদের অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, মুখোমুখি হওয়ার মতো ক্ষমতা কি আদৌ আছে ব্রাজিল-আর্জন্টিনার?
দু’জনেই তারকা ফুটবলার। দু’জনের কাঁধেই রয়েছে ফুটবল আবেগে ভাসা দুই সংস্কৃতিকে মোক্ষ এনে দেওয়ার দায়িত্ব। দু’জনকে দেখবেন বলে দুই সংস্কৃতির বিন্দু বিসর্গও না জানা পৃথিবীজোড়া ফুটবলপ্রেমীরা চোখ পাতবেন এলইডি পর্দায়। ফুটবলে ভাগ্য দরকার ঠিকই। কিন্তু দক্ষতাও তো দরকার!
শুক্রবার নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে পরীক্ষা দিতে নামবে আর্জেন্টিনা। এই নেদারল্যান্ডসকে হারিয়েই ১৯৭৮ সালে প্রথম বিশ্বকাপ জিতেছিল মারাদোনার দেশ।
সেই ইতিহাস শুক্রবারের ম্যাচের আগে মনেও করিয়ে দিয়েছেন টিউলিপের দেশ নেদারল্যান্ডসের কোচ লুই ফান হাল। বলেছেন, ‘‘পুরনো হিসাব মেটানোর আছে।’’
মেসিকেও এক সময় প্রশিক্ষণ দিয়েছেন ফান হাল। বার্সাতে কোচ ছিলেন তিনি। অনেকেই মনে করছেন, মেসির দুর্বলতার জায়গাগুলো জানা আছে তাঁর। ফলে শুধু মেসির উপর ভরসা করলে আর্জেন্টিনা বিপদে পড়তে পারে।
অন্য দিকে, তারকা হলেও এখন ব্রাজিল আর নেমার-নির্ভর নয় পুরোপুরি। উল্টে নেমারকে ছাড়াই বেশ কয়েকটি ম্যাচ জিতে গিয়েছে সাম্বার দেশ। সেক্ষেত্রে শুক্রবারও ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে নেমার মাঠে নামবেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
এই বিশ্বকাপে অঘটন তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে ক্রমশ। হতেই পারে ব্রাজিল ছিটকে গেল শেয আট থেকে। ভক্তদের কাঁদিয়ে বেরিয়ে গেল ফুটবলের ‘ঈশ্বর’ মেসির আর্জেন্টিনাও।
সেই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেও মঙ্গলবারের সেমিফাইনালের আশায় বাঁচছেন ফুটবল ভক্তরা।
কারণ ১৮ ডিসেম্বর ফাইনালে যাঁরাই খেলুন, এক মাচের বাধা ঠিকঠাক কাটলে ১৩ ডিসেম্বরই হবে তাঁদের কাছে বিশ্বকাপের আসল খেলা। যে দিন হয়তো মাঠে নেমে মুখোমুখি যুদ্ধ করবেন ক্লাবের হয়ে পাশাপাশি খেলা দুই ভাই।