খেলার বয়স তখন ৬৩ মিনিট। একটিও গোল হয়নি। মেক্সিকো-আর্জেন্টিনার ম্যাচ দেখতে যাঁরা রাত জাগছিলেন, তাঁদের কেউ হতাশ, কেউ তন্দ্রাচ্ছন্ন। ঠিক তেমন মুহূর্তে জ্বলে উঠলেন তিনি। লিয়োনেল মেসির পায়ে লেগে কোনও এক অদৃশ্য জাদুর ছোঁয়ায় বল জড়িয়ে গেল জালে।
ফুটবল দেখতে যাঁরা ভালবাসেন, শনিবারের রাত তাঁদের মনে থেকে যাবে অনেক দিন। মেসির এই একটি মাত্র গোলের জন্য আরও অনেক রাত জাগবেন তাঁরা। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ধাক্কা খাওয়ার পর ধুঁকতে থাকা আর্জেন্টিনা শিবিরে প্রাণ ফেরালেন অধিনায়ক মেসি।
ম্যাচের প্রথমার্ধে গোলশূন্য ছিল। দ্বিতীয়ার্ধে ৬৩ মিনিটের মাথায় ডান দিক থেকে দি মারিয়ার পাসে বল পান মেসি। তখনও তিনি বক্স থেকে অনেকটা দূরে। বল পায়ে ধরে এক মুহূর্ত অপেক্ষা করেননি আর্জেন্টিনীয় অধিনায়ক।
মেসির নিচু গড়ানো শট পায়ের জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে গোলার মতো ছুটে যায় গোলপোস্টের দিকে। মেক্সিকোর একাধিক ডিফেন্ডার এবং অত্যন্ত কুশলী গোলরক্ষক গুলেরমো ওচোয়াকে থমকে দিয়ে চোখের পলকে বল জড়িয়ে যায় জালে। সমর্থকরা যে গোল দেখে রাতজাগা সার্থক মনে করছেন।
মেসির গোলের পর কাতারের গ্যালারির চেহারাটাই যেন পাল্টে গিয়েছিল। যে নীল-সাদা সমর্থকরা গ্যালারিতে উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা যেন এই ৬৩ মিনিট নিশ্বাস নেননি। দম বন্ধ করে বসেছিলেন। মেসির একটি গোল তাঁদের অক্সিজেন দেয়।
গ্যালারিতে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়তে দেখা যায় মেসির পরিবারকে। সে উচ্ছ্বাস ভাষার অতীত। স্ত্রী আন্তোনেলা এবং মেসির পুত্ররা গ্যালারিতেই ছিলেন। পরিবারের অন্যান্যরাও মাঠে এসেছিলেন ম্যাচ দেখতে। গোল করার পরমূহূর্তে তাঁরা লাফিয়ে ওঠেন। একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন। ছেলেকে জাপটে চিৎকার করে ওঠেন আন্তোনেলা।
মেসির গোল কাঁদিয়ে দিয়েছে আর্জেন্টিনার কোচকেও। ক্যামেরায় ধরা পড়েছে পাবলো আইমারের আবেগতাড়িত কান্না। আর্জেন্টিনার অনূর্ধ্ব ১৭ দলের কোচ তিনি। তাঁর ঠিক পাশেই বসে ছিলেন মেসিদের কোচ লিয়োনেল স্কালোনি। উত্তেজিত দেখায় তাঁকেও।
মেসির পর শনিবারের ম্যাচে দ্বিতীয় গোলটি করেন এনজ়ো ফের্নান্দেস। জয়ের পর আর্জেন্টিনার সাজঘরের ছবিও প্রকাশ্যে এসেছে। তাতে দেখা গিয়েছে, গোটা দল কী ভাবে একটি জয়কে আঁকড়ে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছে।
মেক্সিকো ম্যাচে জয়ের পর সাজঘরে গিয়ে উদ্যাপনে মাতেন মেসিও। জামা খুলে তিনি বাকিদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে চিৎকার করছিলেন। আনন্দে দু’হাত তুলে লাফাচ্ছিলেন। শিশুর মতো হাততালি দিয়ে উঠছিলেন থেকে থেকে। ভিডিয়োতে ধরা পড়েছে সে সব দৃশ্য।
কাতারের গ্যালারি থেকে শুরু করে আর্জেন্টিনার সাজঘর— যাবতীয় উল্লাসে লুকিয়ে ছিল এক রাশ স্বস্তি। মেসিকে গোল করতে দেখে আন্তোনেলা যে ভাবে লাফিয়ে উঠলেন, তাতে কোথাও যেন অস্বস্তির কাঁটা উপড়ে ফেলার শান্তি মিশে ছিল।
অতি বড় আর্জেন্টিনীয় সমর্থকও অস্বীকার করতে পারবেন না, কাতারে বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া দল বড় বেশি মেসি-নির্ভর। তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছেন দলের বাকি ফুটবলাররা। তাই প্রথমার্ধে মেসি পারেননি বলে সাফল্যের মুখ দেখেনি দলও।
আর্জেন্টিনার খেলা যাঁরা দেখেছেন, প্রথমার্ধে নীল-সাদা জার্সির ‘খারাপ ফুটবল’ নিয়ে প্রায় সকলেই এক মত। আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের বল পেলেই মেসিকে খুঁজতে থাকার প্রবণতা চোখে লেগেছে বারবার। বাকি বিশ্বকাপগুলির মতো কাতারেও মেসি-নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি আর্জেন্টিনা, বিশ্বকাপের দ্বিতীয় ম্যাচেই তা পরিষ্কার। যদিও মেসি ভক্তদের অনেকেই বলছেন, ৬৪ মিনিটের ওই মুহূর্তটার জন্যই চোখের ঘুম তাড়িয়ে রাত জেগে বসে থাকা।
রেকর্ডের খাতায় অবশ্য পিছিয়ে নেই মেসি। শনিবার চলতি বিশ্বকাপে নিজের দ্বিতীয় গোলটি করেছেন তিনি। সেই সঙ্গে গোলের রেকর্ডে ছুঁয়ে ফেলেছেন দিয়েগো মারাদোনা এবং ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে।
বিশ্বকাপে ৮টি গোল রয়েছে মারাদোনার। রোনাল্ডোরও গোল সংখ্যা ৮। মেক্সিকোর বিরুদ্ধে গোল করে মেসিও বিশ্বকাপে ৮টি গোল করে ফেলেছেন শনিবার।
যদিও এ ক্ষেত্রে মারাদোনা বা মেসির থেকে কিছুটা এগিয়েই আছেন রোনাল্ডো। পর্তুগাল তারকার ৮ গোল হয়েছে ১৮টি ম্যাচ খেলে। অন্য দিকে, মেসি ও মারাদোনা দু’জনেই বিশ্বকাপে ২১টি ম্যাচ খেলে ৮ গোল করেছেন।
আর্জেন্টিনা এবং মেসির সামনে এখন আর ৫টি ম্যাচ। এমন ‘ঘুম-তাড়ানো’ মুহূর্ত আগামী ৫ ম্যাচে তৈরি করতে হবে মেসিকেই। তাঁর বিশ্বকাপ ছুঁয়ে দেখার স্বপ্নপূরণের জন্য চাই শনিবারের মতো আরও অন্তত ৫টি ম্যাজিক।
আন্তোনেলার উচ্ছ্বাস, সাজঘরের লম্ফঝম্ফ কিংবা জার্সি খুলে স্বয়ং মেসির চিৎকার, মেক্সিকো ম্যাচের পর এই টুকরো ছবিগুলি আগামী ৫ ম্যাচের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে বারবার। গ্রুপ লিগে মেসিদের পরবর্তী ম্যাচ পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে। তা যদি তাঁরা জিততে পারেন, তবে সামনে বাকি থাকবে ৪টি ম্যাচ।
পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে গ্রুপের শেষ ম্যাচ, প্রি-কোয়ার্টার ফাইনাল, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল এবং ফাইনাল— ৫ ম্যাচের অগ্নিপরীক্ষা পার করতে পারলে মেসি স্বপ্ন ছুঁতে পারবেন। স্বপ্ন পূরণ হবে আর্জেন্টিনারও।
২০১৬ সালে এক বার কোপা আমেরিকায় হারের পর অবসর ঘোষণা করে ফেলেছিলেন মেসি। একরাশ হতাশা নিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন, দেশের জার্সিতে আর তিনি মাঠে নামবেন না। পরে অবশ্য অবসরের সিদ্ধান্ত তিনি পুনর্বিবেচনা করেন। ফের নীল-সাদা জার্সিতে মাঠে ছুটতে দেখা যায় তাঁকে।
প্রশ্ন উঠছে, এত কিছুর পরেও কেন মেসির উপর নির্ভর করে থাকা আর্জেন্টিনা দলের চরিত্রগত বদল চোখে পড়ছে না। ফুটবলের দেশ ব্রাজিল। তাদের প্রতিবেশী আর্জেন্টিনা কি পারবে না মেসির ছায়া থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র, পরিণত ফুটবল খেলতে? আপাতত সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পোল্যান্ড ম্যাচের দিকে তাকিয়ে সমর্থকরা।