রেস্তরাঁয় গিয়েছেন। দুপুর অথবা রাতের পেটপুজোটা জমিয়ে হবে, এই আশায় পছন্দের খাবার অর্ডারও করে ফেলেছেন। খাওয়ার আগে সুস্বাদু সুখাদ্যের কল্পনায় যখন আপনি মশগুল, ঠিক তখন হয়তো দেখলেন, যা চেয়েছিলেন তেমনটা হয়নি।
হয়তো রেস্তরাঁয় গিয়ে আপনি চিকেনের কোনও পদ অর্ডার করেছেন। কিন্তু দেখা গেল, চিকেন নয়, আপনার পাতে পড়েছে মটন। চিংড়ি, ভেটকি, এমনকি মুরগির মাংসের বদলে আপনাকে নিরামিষ কোনও পদও খেতে হতে পারে! এমনই সেই রেস্তরাঁর চল।
তবে ভুল পদের জন্য সেই রেস্তরাঁয় কোনও অশান্তি করা যায় না। বরং হাসিমুখে খাবারের থালা হাতে তুলে নেন গ্রাহকেরা। রেস্তরাঁ কর্মীদের সঙ্গে মিলেমিশে হাসিঠাট্টায় কাটিয়ে দেন বাকিটা সময়। সঙ্গে চলে ‘ভুল’ খাবারের পেটপুজো।
গল্পকথা নয়। কোনও খেয়ালি মনের আজগুবি ভাবনাও নয়। সত্যি সত্যিই এমন এক রেস্তরাঁ আছে। যেখানে গেলে অর্ডার অনুযায়ী খাবার মেলে না বললেই চলে। কিছু একটা অর্ডার দিতে হয় ঠিকই, কিন্তু কী খাবার পাতে পড়বে, তা কেউ জানেন না!
জাপানের এই রেস্তরাঁর নাম ‘রেস্টুরেন্ট অফ মিসটেকেন অর্ডার্স’। নামেই লুকিয়ে রয়েছে তার কারসাজি। অর্ডার অনুযায়ী ভুল খাবারই এই রেস্তরাঁর ‘ট্রেন্ড’। কিন্তু কেন এমন হয়?
আসলে রেস্তরাঁর ‘ভুল’গুলি একটিও ইচ্ছাকৃত নয়। তা সেখানকার কর্মীদের বাধ্যবাধকতা। কারণ তাঁরা প্রত্যেকেই ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। তাঁদের ভুলে যাওয়ার রোগ আছে।
ডিমেনশিয়া গোটা জাপানেই একটি গুরুতর সমস্যা। দেশটিতে জন্মের হার অত্যন্ত কম। ফলে সমাজে বয়স্কদের আধিক্য রয়েছে। আর বয়স্ক নাগরিকদের অধিকাংশ ডিমেনশিয়া রোগে আক্রান্ত।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৫ সালের মধ্যে জাপানের প্রতি পাঁচ জন নাগরিকের মধ্যে এক জন ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন। দেশের জন্মহারে হ্রাস নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী ফুমিয়ো কিশিদা।
এই ডিমেনশিয়ার আঁচলের নীচেই জাপানের ‘রেস্টুরেন্ট অফ মিসটেকেন অর্ডার্স’। রেস্তরাঁটির মালিক শিরো ওগুনি। ইচ্ছা করেই তিনি ডিমেনশিয়া আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে এই রেস্তরাঁ চালু করেছেন।
রেস্তরাঁর ব্যবসা ওগুনির অগ্রাধিকার নয়, ডিমেনশিয়া নিয়ে সমাজে সচেতনতা প্রসার করা তাঁর মূল লক্ষ্য। ডিমেনশিয়া এবং তাতে আক্রান্তদের সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা বদলে দিতে চান ওগুনি।
তিনি জানান, ডিমেনশিয়া রোগীদের নিয়ে তাঁরও একসময় বাকিদের মতোই ধারণা ছিল। তিনিও মনে করতেন, এই রোগে আক্রান্তেরা দিক্ভ্রান্তের মতো এ দিক সে দিক ঘুরে বেড়ান, কোনও কথাই মনে রাখতে পারেন না।
কিন্তু বাস্তবে এই রোগ তেমন নয়। ওগুনি বুঝেছেন, ডিমেনশিয়া রোগীরাও আর পাঁচ জন সাধারণ মানুষের মতো নিজেদের মতো করে প্রতি দিনের কাজকর্ম করতে পারেন। তাঁরা রান্না করেন, বাজার করেন, এমনকি ঘরদোরও গুছিয়ে রাখেন বাকিদের মতো।
ওগুনি নিজে এক বার এক রেস্তরাঁয় ডিমেনশিয়া রোগীর মুখোমুখি হয়েছিলেন। তিনি যে খাবার চেয়েছিলেন তা পাননি। হামবার্গার অর্ডার করে তাঁকে সে দিন খেতে হয়েছিল মোমো। সেই থেকেই এই ধরনের রোগীদের নিয়ে আলাদা একটি রেস্তরাঁ খোলার পরিকল্পনা মাথায় আসে ওগুনির।
কী কী হয় ‘রেস্টুরেন্ট অফ মিসটেকেন অর্ডার্স’-এ? এই রেস্তরাঁয় শুধু ভুল খাবারই পরিবেশন করা হয় না, রেস্তরাঁটি আদ্যোপান্ত ভুলে ভরা। এখানে কেউ খেতে এলে তাঁকে আসন দেখিয়ে দেন কর্মী। তার পর হয়তো নিজেই সেই আসনে গিয়ে বসে পড়েন।
আবার, রেস্তরাঁর কোনও রাঁধুনি হয়তো রান্নার পর কোন পদে গোলমরিচ ছড়িয়ে দেবেন, তা ভুলে গিয়ে মাথা চুলকোচ্ছেন। বাকিরা এগিয়ে আসেন তাঁর সাহায্যে। সকলে মিলে কাজ সম্পূর্ণ করে একসঙ্গে হেসে ওঠেন তাঁরা। খুশিই এই রেস্তরাঁর জনপ্রিয়তার চাবিকাঠি।
ডিমেনশিয়াকে ঠাট্টার পাত্রে পরিণত করার অভিযোগ তুলে ওগুনির বিরুদ্ধে থেকে থেকেই ধেয়ে আসে সমালোচনা, কটূক্তি। কিন্তু নিজের কাজ সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী এই জাপানি ব্যবসায়ী।
ওগুনি জানান, ডিমেনশিয়া নিয়ে ব্যবসায়িক সাফল্য নয়, আসলে তাঁর লড়াই ডিমেনশিয়ার বিরুদ্ধেই। বার্ধক্যজনিত এই রোগ সমাজের কাঁধে অভিশাপের মতো চেপে বসেছে। তার মাঝেই আশীর্বাদ খুঁজতে চান তিনি। তাই ভুল খাবার খেতেই তাঁর রেস্তরাঁয় ভিড় করেন মানুষ।