মন্দির শহর না কি দুর্গ শহর! বোঝা দায়। মন্দিরের ঘণ্টা-মন্ত্রোচ্চারণ আর তাঁর ফাঁক গলে দিনের চার প্রহরে আজানের শব্দে গমগম করা কাশী হঠাৎ থমথমে হয়ে গিয়েছিল সোমবার সকালে। সুনসান গলিতে ১৪৪ ধারা। চারপাশে কড়া নিরাপত্তার বেষ্টনী। রক্ষীদের পল্টন তো রয়েছেই। পাশাপাশি সীমান্ত এলাকা থেকে হোটেল এবং গেস্ট হাউসে কারা আসছেন এবং যাচ্ছেন, সব দিকে কড়া নজরে রাখছিল পুলিশ। এই নিরাপত্তা, এই সতর্কতার কেন্দ্রে ছিল আদালতের একটি রায়। সেই রায় যা কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরের লাগোয়া জ্ঞানবাপী মসজিদ স্থলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। ঠিক করে দেবে মসজিদ চত্বরে পূজার্চ্চনার অনুমতি চেয়ে পাঁচ হিন্দু মহিলার আবেদন আদৌ গ্রাহ্য হবে কি না। সোমবার সেই মামলা শুনতে রাজি হয়েছে বারাণসীর জেলা আদালত। কিন্তু কেন এই মামলা ঘিরে এত সতর্কতা, কেন এত সাবধানী প্রশাসন! আসুন জেনে নিই।
মামলার নাম জ্ঞানবাপী মসজিদ-শৃঙ্গার গৌরীস্থল মামলা। ২০২১ সালে দায়ের হওয়া এই মামলার দাবি, জ্ঞানবাপী মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল হিন্দুদের প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপর। জ্ঞানবাপী মসজিদের ওজুখানা এবং তহখানা চত্বর, যেখানে নমাজ পড়ার আগে হাত-মুখে ধুয়ে নেন প্রার্থনা করতে আসা মানুষজন, তার মাটিতে শিবলিঙ্গ রয়েছে বলেও দাবি করা হয় মামলায়। বস্তুত সেই স্থলে পুজো-অর্চনার অনুমতি চেয়েই আদালতে যান পাঁচ হিন্দু মহিলা।
মামলায় বলা হয়েছিল, মসজিদের ওজুখানা এবং তহখানা চত্বর আসলে পুরনো মন্দিরে মা শৃঙ্গার গৌরী স্থল বলে পরিচিত ছিল। এ ছাড়া মসজিদে ভিতরের অংশে পশ্চিম দিকের দেওয়ালে দেবদেবীর মূর্তির অস্ত্বিত্ব রয়েছে জানিয়ে সেখানেও পুজো করতে চেয়েছিলেন মামলাকারী পাঁচ মহিলা। মসজিদ কর্তৃপক্ষ সেই দাবি খারিজ করে দেন। দু’পক্ষের এই দাবি আর পাল্টা দাবি ঘিরেই নতুন করে শুরু হয় জ্ঞানবাপী মসজিদ তরজা। যা এর আগেও বহুবার প্রকাশ্যে এসেছে।
সঙ্ঘাতের বীজ বপন হয়েছিল আনুমানিক ১১৯৪ সালেই, মসজিদ সংক্রান্ত একটি ইতিহাস অন্তত তেমনই বলছে। এই ইতিহাস এ-কথাও বলছে যে, এখন যেখানে জ্ঞানবাপী মসজিদ, সেখানে বহু পুরনো হিন্দু মন্দির ছিল। কিন্তু ইরান থেকে সুলতানি শাসনের প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ ঘোরীর বাহিনী যখন রাজা জয়চন্দ্রকে পরাজিত করে কনৌজের দখল নিলেন, তখন সেই মন্দির ভেঙে দেওয়া হয়। মন্দিরের সেই ধ্বংসাবশেষের উপরেই তৈরি হয়েছিল রাজিয়া মসজিদ। এর পর নাকি বহু বার মন্দির ভেঙে মসজিদ, মসজিদ ভেঙে মন্দির হয়েছে জ্ঞানবাপীতে।
ইতিহাসবিদদের একাংশ বলছেন, দ্বাদশ শতকে সুলতান ইলতুৎমিসের সময়ে এক গুজরাতি ব্যাবসয়ী আবার মন্দির তৈরি করেছিলেন এই স্থানে। যা আবার চতুর্দশ শতকে ভেঙে ফেলেন কোনও এক মুসলিম শাসক। তিনি হুসেন শাহ সারকি হতে পারেন। আবার সিকন্দর লোধিও হতে পারেন। আকবরের জমানায় রাজা মান সিংহ নাকি আবারও মন্দির বানিয়েছিলেন জ্ঞানবাপীর এই চত্বরে, যা অওরঙ্গজেবের হাতে আবার ধ্বংস হয়।
জ্ঞানবাপীর ওই চত্বরে মন্দির থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় অওরঙ্গজেবের সময়কার এক ইতিহাসবিদের লেখা পুঁথিতে। ‘মা আশয়ের আলম গিরি’ নামে অওরঙ্গজেব জমানার বর্ণনা-সমৃদ্ধ একটি বইতে ওই ইতিহাসবিদ লিখেছিলেন, এখন যেখানে জ্ঞানবাপী মসজিদ সেখানে ষোড়শ শতকে হিন্দুদের মন্দির ছিল।
ব্রিটিশ জমানাতে যখন জ্ঞানবাপীর জমিতে মন্দির গড়ার দাবি ওঠে এবং ১৯৩৭ সালে বারাণসীর আদালত জ্ঞানবাপীতে নমাজের অধিকার বজায় রাখে, তখন সেই বইয়ের কথা উল্লেখ করেছিলেন বারাণসীর এক শিক্ষাবিদ প্রফেসর পরমাত্মা স্মরণ।
১৯৩৭ সালের ১৪ মে, ওই বইয়ের ওই বিশেষ অংশটির উল্লেখ করে ব্রিটিশ শাসককে জানিয়েওছিলেন বারাণসীর ওই শিক্ষাবিদ ব্রিটিশ সরকারের অনুমতিসাপেক্ষে পরে তিনি এ নিয়ে একটি বিবৃতিও দেন। কিন্তু তার পরও ১৯৪২-এ ইলাহাবাদ হাই কোর্ট জ্ঞানবাপীতে নমাজের অধিকার বজায় রাখার রায় বহাল রেখেছিল। ফলে বিতর্ক চলতে থাকে।
পরে ইতিহাসবিদদেরই একাংশ জানান, জ্ঞানবাপী মসজিদ চত্বরে শিব মন্দির ছিল। কাশীর বিশ্বনাথের পাশেই বিশ্বেশ্বরের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা টোডরমল। আকবরের রাজত্বে মুঘল সম্রাটের অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। বারাণসীর ব্রাহ্মণ সমাজের নেতা নারায়ণ ভট্টের সঙ্গে মিলে তখনই ওই মন্দির তৈরি করেন। যা সে সময়ের বহু শিক্ষিত শাস্ত্র চর্চাকারীদের মিলনকেন্দ্র হয়ে ওঠে।
১৯৯১ সালে টোডরমলের সেই বিশ্বেশ্বর শিবের নামেই আদালতে জ্ঞানবাপী মসজিদের অস্তিত্ব অস্বীকার করে মামলা দায়ের হয়। বিজয় শঙ্কর রস্তোগি নিজেকে বিশ্বেশ্বর শিবলিঙ্গের ‘বন্ধু’ আখ্যা দিয়ে আদালতে দাবি করেন, এখন যেখানে জ্ঞানবাপী মন্দির, সেখানে বহু বছর আগে রাজা বিক্রমাদিত্যের তৈরি মন্দির ছিল। এই যুক্তিতেই তিনি ওই মসজিদ ভেঙে হিন্দুদের হাতে জমির অধিকার তুলে দেওয়ার আর্জি জানান।
রস্তোগির ওই দাবির জবাবে ১৯৯১ সালের উপাসনাস্থল রক্ষা (বিশেষ ব্যবস্থা) আইনের কথা বলে আদালত। নরসিংহ রাওয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় পাশ হওয়া ওই আইনের চার নম্বর ধারা বলছে, ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্টের আগে থেকে দেশে যে সব ধর্মীয় কাঠামো রয়েছে, তার চরিত্র কোনও ভাবেই পাল্টানো যাবে না। যদিও মামলাকারী জানিয়ে দেন, ১৯৯১ সালের ওই আইন জ্ঞানবাপীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ ওই মসজিদ একটি অর্ধেক ধ্বংস হওয়া মন্দিরের স্থলে বানানো হয়েছে।
১৯৯১-এ সোমনাথ ব্যাস এবং রামরঙ্গ শর্মা নামে দুই আবেদনকারীও জ্ঞানবাপী মসজিদে হিন্দুদের অধিকারের দাবিতে একটি মামলা করেছিলেন। তার প্রেক্ষিতে ওই নির্দেশে বলা হয়েছিল, ১৯৯১-এর ধর্মীয় উপাসনাস্থল রক্ষা (বিশেষ ব্যবস্থা) আইন অনুযায়ী জ্ঞানবাপী মসজিদ আবেদনকারী পক্ষকে (হিন্দু) দেওয়া সম্ভব নয়। সেখানে বর্তমান বন্দোবস্তই বহাল থাকবে। যদিও হিন্দু পক্ষের আইনজীবী বিষ্ণু জৈন এবং হরিশঙ্কর জৈনও পাল্টা দাবি করেন, ১৯৯১ সালের ওই আইন জ্ঞানবাপীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তিনি আদালতকে জানান, ১৯৪৭ সালের পরেও শৃঙ্গার গৌরীস্থলে পূজার্চনার প্রমাণ রয়েছে।
১৯৯৮ সালে এই মামলাগুলির উপর স্থগিতাদেশ জারি হয়। এলাহাবাদ হাইকোর্টে অঞ্জুমান ইন্তেজামিয়া (জ্ঞানবাপী) মসজিদ কমিটি ১৯৯১ সালের উপাসনাস্থল রক্ষা (বিশেষ ব্যবস্থা) আইনের উল্লেখ করে বলেন, সিভিল কোর্টে এই মামলার সমাধান সম্ভব নয়। এর পরই মামলার শুনানিতে স্থগিতাদেশ জারি করে হাই কোর্ট।
এর পর কিছু দিনের জন্য থিতিয়ে গিয়েছিল জ্ঞানবাপী মামলা সংক্রান্ত আলোচনা। ২০১৯ সালে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের করিডারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকে কেন্দ্র করে আবার নতুন করে আগুনে ঘি সংযোগ ঘটে। অক্টোবরে ওই করিডোর তৈরির জন্য মসজিদ চত্বরের একটি চবুতরখানা ভেঙে দেওয়া হয়। তাতেই ওই এলাকায় দুই ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনার পরিস্থিতি তৈরি হয়। এর দু’বছরের মাথায় ২০২১ সালের ১৮ এপ্রিল মামলা করেন পাঁচ হিন্দু মহিলা।