প্রবল সমালোচনা ও বিতর্কের মাঝে সম্প্রচার পরিষেবা নিয়ন্ত্রণ বিলের খসড়া প্রত্যাহার করে নিয়েছে কেন্দ্র। বিল পেশ হওয়ার আগে বিল তৈরির প্রক্রিয়া নিয়েই টানাপড়েন চলছে সরকার ও বিরোধী পক্ষের।
সংসদের বাদল অধিবেশন চলাকালীন ২০২৪-এর সম্প্রচার বিলটির খসড়া উত্থাপন করেছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। এই খসড়া বিলের বিরোধিতা করে তৃণমূল, কংগ্রেস-সহ অন্য বিরোধীরা।
আপত্তি ওঠে সংশ্লিষ্ট পক্ষ থেকেও। এই চাপের মুখেই প্রস্তাবিত সম্প্রচার পরিষেবা নিয়ন্ত্রণ বিলের একটি নতুন খসড়া প্রকাশ করা হবে বলে কেন্দ্রের তরফে জানানো হয়।
কী এই প্রস্তাবিত সম্প্রচার পরিষেবা নিয়ন্ত্রণ বিল যা নিয়ে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। কাদের মুখে লাগাম পরাতে উদ্যোগী কেন্দ্র? বিরোধীদের অভিযোগই বা কী?
এই নতুন বিলে প্রস্তাব করা হয়েছে, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম-সহ জনপ্রিয় সমাজমাধ্যম প্রভাবীদেরও এ বার থেকে ত্রিস্তরীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার আওতায় আনা হবে। সম্প্রচার বিল পাশ হলে তা ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম প্রভাবীদের সরকারি খাতায় নাম লেখাতে হবে।
যে কেউ সমাজমাধ্যমে ভিডিয়ো আপলোড করলে, পডকাস্ট করলে, সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে লিখলেই তাঁকে ‘ডিজিটাল সংবাদ সম্প্রচারকারী’ হিসাবে ধরে নেওয়া হবে।
সম্প্রচার পরিষেবা নিয়ন্ত্রণ বিলের খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘ডিজিটাল নিউজ় ব্রডকাস্টার’ নামে একটি নতুন বিভাগ চালু করতে চায় কেন্দ্র। সমাজমাধ্যমে কোনও কিছু প্রকাশের আগে সেই ভিডিয়ো বা পডকাস্ট খতিয়ে দেখার জন্য কমিটি তৈরি রাখতে হবে। সেই কমিটিতে কারা থাকবেন সেই সম্পর্কেও সম্পূর্ণ তথ্য জানাতে হবে সরকারকে।
যে সব ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম প্রভাবীরা সমাজমাধ্যম থেকে আয় করেন তাঁদের গ্রাহক কত বা কারা, সেই তথ্যও সরকারকে জানাতে হবে। না হলে আইনি পদক্ষেপের মুখে পড়তে হতে পারে।
নয়া বিলে সমাজমাধ্যম প্রভাবীদের নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে মোদী সরকার, এই অভিযোগ তুলে বার বার বিলের বিরোধিতা করেছে বিরোধীরা। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর পছন্দ না হলে তা ‘ভুয়ো খবর’ বলে সেই খবর নিয়ন্ত্রণের রাশ নিজেদের হাতে তুলে নিতে চাইছে এই বিলের মাধ্যমে, এমনটাই মত বিরোধী দলগুলির।
কংগ্রেসের অভিযোগ, মোদী সরকার এত দিন সংবাদমাধ্যমকে চোখ রাঙিয়ে, লাগাম পরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। প্রাতিষ্ঠানিক সংবাদমাধ্যমের পরে এ বার সমাজমাধ্যমের পায়ে বেড়ি পরাতে চাইছে।
সরকারের ভুলত্রুটি তুলে ধরে যে সব সাংবাদিক স্বাধীন ভাবে ইউটিউব বা ডিজিটাল মাধ্যমে সমালোচনা করছেন তাঁদের উপর নজরদারি করার উদ্দেশ্যেই এই বিল আনা হচ্ছে বলে সরব বিরোধীরা।
নতুন বিল এনে সেই সব সাংবাদিকের কণ্ঠরোধের চেষ্টা চালানো হচ্ছে বলেও দাবি। বিরোধীদের অভিযোগ, নয়া বিলে সরকারি নিয়ন্ত্রণ বলবৎ করে সরাসরি বাক্স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে চাইছে সরকার।
ভিডিয়ো বা পডকাস্ট খতিয়ে দেখার জন্য কমিটির খরচ প্রভাবীদেরই বহন করতে হবে বলেও এই বিলে বলা হয়েছে বলে দাবি।
মোদী সরকার ১৯৯৫ সালের কেবল টিভি নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ আইন তুলে দিয়ে নতুন সম্প্রচার পরিষেবা নিয়ন্ত্রণ বিল আনতে চাইছে। ২০২৩-এ সে কারণে একটি সংশোধনী আইনের প্রস্তাব করে সরকার।
কিন্তু বিল পেশ হওয়ার আগে তার খসড়া প্রস্তুতির প্রক্রিয়া নিয়েই বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। বিরোধীদের অভিযোগ, সংসদে খসড়া পেশ হওয়ার আগেই তা প্রকাশ্যে এসে গিয়েছিল।
তবে কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের পাল্টা দাবি ছিল, বিভিন্ন পক্ষ এবং জনসাধারণের মতামত চেয়ে তা ২০২৩ সালের অক্টোবরে মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছিল।
তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ ও প্রসার ভারতীর প্রাক্তন আধিকারিক জহর সরকার এই বিল নিয়ে রাজ্যসভায় প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাঁর সুস্পষ্ট অভিযোগ, সম্প্রচার বিলের খসড়া বদলে ফেলা হয়েছে।
তার পরে তা গোপনে ব্যবসায়ী সংস্থাগুলিকে দেখানো হয়েছে বলেও দাবি করেছেন জহর। মোদী সরকার সংসদের সদস্যদের থেকে তথ্য গোপন করছে, অথচ ব্যবসায়ী সংস্থার হাতে বিলের তথ্য পৌঁছে যাচ্ছে, এমনটাই মত তাঁর।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের দিকে নজর রেখে ২০২৩ সালে এই বিলের প্রস্তাব করেছিল সরকার। কারা সরকারের কাজের খুঁত, ভুলত্রুটি তুলে ধরছেন জনসমক্ষে তা দেখার জন্যই সরকার এই বিলের খসড়া প্রকাশ করেছিল।
যা নিয়ে ব্যপক প্রতিক্রয়া দেখা দেয় সমাজমাধ্যমে ও সংসদেও। ঘরে-বাইরে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে তাই সম্প্রচার পরিষেবা নিয়ন্ত্রণ বিলের খসড়া প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় সরকার। এমনটাই মত রাজনৈতিক মহলের।