আবার ধাক্কা খেল ভারতের রফতানি বাণিজ্য। যা নিয়ে কেন্দ্রের দেওয়া পরিসংখ্যানে ভুরু কুঁচকেছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। গত ৯ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে সরকার।
মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর আমদানি ও রফতানির পরিসংখ্যান প্রকাশ করে বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রক। সেখানে বলা হয়েছে, চলতি বছরের অগস্টে ভারতের রফতানি বাণিজ্য কমেছে ৯ শতাংশ। অন্য দিকে, আমদানির পরিমাণ তিন শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, রফতানি বাণিজ্য মার খাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকায় ভারতীয় পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়া। যা যথেষ্ট চিন্তার বলে দাবি করেছেন তাঁরা। অগস্টে আমদানি ও রফতানির মধ্যে ফারাক প্রায় ২.৫১ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্র।
সরকার জানিয়েছে, এ বছরের অগস্টে ২.৯ লক্ষ কোটি টাকার পণ্য রফতানি করা হয়েছে। গত বছর (২০২৩) যা ছিল ৩.২ লক্ষ কোটি টাকা। একই ভাবে ২০২৩ সালের অগস্টের নিরিখে এ বছর বেড়েছে আমদানির পরিমাণও।
কেন্দ্র জানিয়েছে, চলতি বছরের অগস্টে ৫.৩৮ লক্ষ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করা হয়েছে। ২০২৩ সালের অগস্টে যা ছিল ৫.২১ লক্ষ কোটি টাকা। গত ১০ মাসের ঘাটতি আগামী দিনে কমানোর চেষ্টা হচ্ছে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রক।
এই আবহে মোটেই আশার কথা শোনায়নি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজ়েশন (ডব্লিউটিও)। তাঁদের দাবি, ২০২৪ সালের শেষ লগ্নে উন্নত হবে বিশ্ব বাণিজ্য। সে ক্ষেত্রে অধিকাংশ দেশের আর্থিক নীতিতে আসতে পারে বড় বদল। তবে সে ক্ষেত্রে রফতানিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
রফতানি বাণিজ্য কোথায় কতটা মার খেয়েছে, তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করেছেন বাণিজ্য সচিব সুনীল বার্থওয়াল। তাঁর কথায়, ভারতের পেট্রোলিয়াম বাণিজ্যে পড়েছে চিনে আর্থিক মন্দার প্রভাব। তবে এতে আবার পেট্রোলিয়াম আমদানিতে কিছুটা সুবিধা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মস্কোর থেকে কম দামে অপরিশোধিত তেল আমদানি করছে ভারত। সেই তেল পরিশোধন করে ইউরোপ তথা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্রি করেছে তেল সংস্থাগুলি। রাশিয়ার উপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এই বাণিজ্যে তেমন প্রভাব পড়েনি বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রের বাণিজ্য সচিব সুনীল বার্থওয়াল।
তবে রাশিয়ার উপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞার জেরে হিরে রফতানির উপর প্রভাব পড়েছে বলে জানিয়েছেন সুনীল। তিনি জানিয়েছেন, “রফতানি বৃদ্ধির জন্য আমরা আর শুধু ইউরোপের বাজারের উপর নির্ভর করছি না। আফ্রিকার দেশগুলিতে ভারতীয় পণ্য কী ভাবে আরও বেশি পরিমাণে বিক্রি করা যায়, সে দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে।”
অন্য দিকে, উৎসবের মরসুমের আগে অগস্টে বিপুল পরিমাণে বেড়েছে সোনা-রুপোর আমদানি। এ বছরের বাজেটে হলুদ ধাতুর উপর আমদানি শুল্প কমিয়েছে কেন্দ্র। যা এই আমদানি বৃদ্ধির মূল কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
রফতানি কমার নেপথ্যে কেন্দ্রের যুক্তি হল, আর্থিক মন্দার মুখে পড়েছে ইউরোপের অধিকাংশ উন্নত দেশ। আর তাই মন্দার প্রভাব মারাত্মক ভাবে পড়বে না, এমন দেশগুলিকে বেছে নেওয়া হচ্ছে। সেখানে ভারতীয় পণ্য ছড়িয়ে দেওয়াই সরকারের লক্ষ্য বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রের বাণিজ্য সচিব।
উল্লেখ্য, বাণিজ্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দীর্ঘ দিন ধরেই কন্টেনারের সমস্যায় ভুগছে অধিকাংশ ভারতীয় সংস্থা। যা দূর করতে জাহাজ মন্ত্রকের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে বাণিজ্য মন্ত্রক। আগামী বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকের মধ্যে এই সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়ে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।
ডব্লিউটিও জানিয়েছে, সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী গত কয়েক মাসে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মোটেই ভাল পারফরম্যান্স করেনি ইউরোপ। সে ক্ষেত্রে আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলি বাড়িয়েছে আমদানির পরিমাণ।
অন্য দিকে, এ বছরের মে মাস থেকে বিশ্বের আর্থিক মন্দার দিকে কড়া নজর রেখে চলেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার বা ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ)। সংস্থাটির দাবি, ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার অনেকটাই বেশি রয়েছে। যা নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলিকে সতর্ক করেছে আইএমএফ।
ডব্লিউটিও-র গুডস ট্রেড ব্যারোমিটার অনুযায়ী, পণ্যদ্রব্য বাণিজ্যের পরিমাণের গতিপথের একটি প্রাথমিক সূচক ১০৩-এ দাঁড়িয়ে রয়েছে। ত্রৈমাসিক বাণিজ্য ভলিউম ও বেসলাইন সূচক আছে ১০০-র উপরে।
এক বিবৃতিতে ডব্লিউটিও জানিয়েছে, এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে যে ২০২৪ সালের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে পণ্যদ্রব্যের বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়তে শুরু করেছে। উন্নত দেশগুলিকে আর্থিক নীতিতে বদল আনতে হবে। নইলে আমদানি ও রফতানি বাণিজ্য বড়সড় সঙ্কটের মুখে পড়তে পারে।
ডব্লিউটিও-র দেওয়া সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে বিশ্ব জুড়ে বাণিজ্য বেড়েছে ১ শতাংশ। গত বছর এই সময়ের নিরিখে যা ১.৪ শতাংশ। গত বছর এই সময়ের ত্রৈমাসিকে তুলনায় এই বছরের এই সময়ের ত্রৈমাসিকের গ্রাফে ০.৭ শতাংশ বৃদ্ধি দেখা গিয়েছে।
প্রসঙ্গত, ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিশ্বের জোগান শৃঙ্খলে জায়গা করে নেওয়ার উপর বার বার জোর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু অগস্টে রফতানি বাণিজ্য কমে যাওয়ায় তাঁর কড়া সমালোচনা করতে ছাড়েননি বিরোধীরা।