দুবাই। বিশ্বের নামীদামি হোটেল, ঝাঁ চকচকে রাস্তা, রেস্তরাঁ, শপিংমল— কী নেই আরব সাগরের তীরের এই শহরে। দুবাই আরবের সব থেকে বড় এবং জনবহুল শহর। বিত্তশালীদের শহরও বটে। দুবাইয়েই রয়েছে বিশ্বের উচ্চতম ইমারত বুর্জ খলিফা (৮২৮ মিটার)।
গত কয়েক দশকের প্রচেষ্টায় দুবাই প্রযুক্তিগত ভাবে বিশ্বের অন্যতম উন্নত শহরে পরিণত হয়েছে। রবার্ট ডি নিরো, কিম কার্দাশিয়ানের মতো আন্তর্জাতিক মানের তারকাদের অবসর যাপনের প্রিয় জায়গা এই শহর। যাঁরা দুবাইতে থাকেন, তাঁদের জীবনযাপনের বাহার দেখলে তৃতীয় বিশ্বে বসবাসকারী যে কোনও সাধারণ মানুষ হতবাক হয়ে যাবেন। বিস্ময়ে প্রশ্ন জাগতে পারে, টাকা থাকলে কী না হয়?
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক এমন কয়েকটি বিস্ময়-বস্তু, যা শুধুমাত্র দুবাইয়েই দেখতে পাওয়া যায়।
‘ধুম-৩’ ছবির সেই দৃশ্যের কথা মনে আছে? যেখানে ব্যাঙ্ক লুটের পর পুলিশের তাড়া খেয়ে আমির খান নিজের মোটরবাইক নিয়ে জলে লাফ দেন। পরে সেই মোটরবাইকই একটি জলযানে রূপান্তরিত হয়ে তাঁকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। সে তো ছিল সিনেমার দৃশ্য। কিন্তু বাস্তবেও এর নিদর্শন রয়েছে। সড়কে চলা গাড়ি যে জলেও চালানো যেতে পারে, তা দুবাই না গেলে বিশ্বাস করা কঠিন।
২০১৩ সালে এই উভচর যান (যে গাড়ি সড়কপথ এবং জলপথ— উভয়েই চলে) প্রথম দুবাইয়ের জল এবং রাস্তায় দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। বর্তমানে এই উভচর যান দুবাইয়ের বিত্তশালীদের জনপ্রিয় বাহনে পরিণত হয়েছে।
দুবাইয়ের যুবরাজ শেখ হামদান বিন মহম্মদ আল-মাকতুমের কাছে এই ধরনের ছ’টি গাড়ি রয়েছে। যে গাড়িগুলির মূল্য ১ লক্ষ ৩৫ হাজার ডলার থেকে শুরু। সড়কপথের মতো জলপথেও এই গাড়ি হু হু গতিতে ছুটে যেতে পারে। বিশেষ এই গাড়ির দেখা দুবাইয়ে মিললেও এই গাড়ি তৈরি করেছে আমেরিকার এক সংস্থা।
দুবাইয়ে এমন অনেক বিলাসবহুল হোটেল আছে যার বেশ কয়েকটি ঘর রয়েছে জলের তলায়। বিছানায় শুয়ে কাচের দেওয়াল থেকে স্পষ্ট দেখা যাবে স্বচ্ছ জলে সামুদ্রিক প্রাণীদের চলাফেরা। তবে এই ঘরগুলিতে থাকার জন্য মোটা টাকা খরচ করতে হয় অতিথিদের।
জলের তলার এই বিলাসবহুল ঘরগুলির মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি বিলাসবহুল হোটেলের ‘নেপচুন’ এবং ‘পসাইডন’ নামের দু’টি ঘর। দুবাইয়ে জলের নীচে থাকা সবচেয়ে বিলাসবহুল ঘরে থাকার জন্য এক জন অতিথিকে প্রায় ২১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হতে পারে।
মনোরঞ্জনের জন্য দুবাইয়ের ধনকুবেররা প্রায়ই উটের দৌড়ের আয়োজন করেন। সেই খেলা সমগ্র আরব আমিরশাহি জুড়েই যথেষ্ট জনপ্রিয়। ২০০৪ সালের আগে পর্যন্ত উটের পিঠে মানুষ চাপিয়ে এই খেলার আয়োজন করা হত। তবে সেই খেলায় উটের পিঠে বসে থাকা সওয়ারিদের গুরুতর ভাবে জখম হওয়ার ইতিহাসও রয়েছে।
মানবাধিকার সংক্রান্ত বহু প্রশ্নের মুখে পড়ে ২০০৪ থেকে উটের পিঠে মানুষের সওয়ারি বন্ধ করা হয়। তার বদলে উটের পিঠে রোবট চড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অ্যালুমিনিয়ামের রোবটগুলির উটের হৃদ্স্পন্দন মাপতে সক্ষম। আর সেই হৃদ্স্পন্দন বুঝে উটের গতি নিয়ন্ত্রণ করে রোবটগুলি।
দুবাইয়ে গিয়ে ট্র্যাফিকে ফেঁসেছেন? অথচ শীঘ্র গন্তব্যে পৌঁছতে হবে? ‘কুছ পরোয়া নহি’। এক ফোনে চলে আসবে ‘দুয়ারে হেলিকপ্টার’ পরিষেবা। ভিড় রাস্তা থেকে গাড়ি তুলে নিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে আসবে হেলিকপ্টার। তবে তার বিনিময়ে খসাতে হতে পারে লক্ষাধিক টাকা।
২০১৭ সালে দুবাইয়ে ‘হেলিকপ্টার ট্যাক্সি’ পরিষেবা প্রথম চালু হয়। এই হেলিকপ্টারগুলি দুবাইয়ের আকাশে চক্কর খেতে থাকে। ফোন পেয়েই পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট জায়গায়।
শুধু বিত্তশালীরা নন, দুবাইয়ের পুলিশও যাতায়াত করে নামীদামি সংস্থার বিলাসবহুল গাড়িতে। উচ্চগতির এই সব গাড়ি নিয়েই অপরাধীদের ধাওয়া করেন শহরের পুলিশ আধিকারিকেরা। দুবাইয়ের পুলিশ যে গাড়িগুলি ব্যবহার করে, সেগুলি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শূন্য থেকে ৯৬-৯৭ কিলোমিটার পর্যন্ত গতি তুলতে পারে। বিলাসবহুল গাড়ি চালান দুবাইয়ের ট্যাক্সি চালকেরাও।
দুবাইয়ে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি এমন একটি দ্বীপ রয়েছে, যা তৈরি হয়েছে বিশ্বের মানচিত্রের আদলে। পাম জুমেইরাহের এই দ্বীপের নাম ‘দ্য ওয়ার্ল্ড’। প্রায় ২৬০টি ছোট ছোট দ্বীপ দিয়ে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড’ তৈরি করা হয়েছে।
২০০৫ সালে দুবাইয়ে তৈরি হওয়া ‘দ্য মল অফ দ্য এমিরেটস’ বিশ্বের বৃহত্তম শপিং মল। এই শপিং মলের মধ্যে রয়েছে এমন একটি জায়গা যা সম্পূর্ণ ভাবে বরফে ঢাকা। সেখানে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে বিভিন্ন প্রজাতির পেঙ্গুইন। ১১ হাজার টাকার বিনিময়ে সেই পেঙ্গুইনদের সঙ্গে অবসর সময়ও কাটানো যাবে। আবার কেউ চাইলে মোটা টাকার বিনিময়ে এবং নির্দিষ্ট শর্ত মেনে পেঙ্গুইনগুলিকে পুষতে পারেন।
সংযুক্ত আরব আমিরশাহির জাতীয় পাখি বাজ। তাই দুবাইয়ের বিত্তশালীদের মধ্যে বাজপাখি পোষার চল রয়েছে। নিজেদের ঠাঁটবাট এবং প্রভাব দেখাতেও অনেকে এই পাখি পোষেন। সমগ্র আরবে বাজপাখির গুরুত্ব প্রচুর। এতটাই গুরুত্ব যে, দুবাইয়ের বিত্তশালীরা যাতে পোষা বাজ নিয়ে অন্য দেশে ভ্রমণ করতে পারেন, তার জন্য আলাদা বিমানের ব্যবস্থা রয়েছে এই শহরে।
দুবাইয়ে গিয়ে যদি চোখ ধাঁধানো কোনও সোনা বা হিরের বড় চাঁই এগিয়ে আসতে দেখেন, তা হলে অবাক হলে চলবে না। সেগুলি আসলে সোনা এবং হিরে দিয়ে মোড়া এক একটি গাড়ি। দুবাইয়ের ধনকুবেররা নিজেদের প্রতিপত্তি দেখাতে সোনা বা হিরে দিয়ে তৈরি এই গাড়ি চ়ড়েন। সৌদি যুবরাজ আল ওয়ালিদ বিন তালাল বিন আবদুল আজিজের কাছে এমন একটি বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে যাতে তিন লক্ষেরও বেশি হিরে ব্যবহৃত হয়েছে।
দুবাইয়ে শুধু টাকার না, সোনার জন্যও এটিএম রয়েছে। বিভিন্ন ওজন এবং আকৃতির সোনার মুদ্রা এবং বাট সেই এটিএম থেকে বার করা যায়। পরিবর্তে খরচ করতে হয় প্রয়োজনীয় অর্থ বা সমপরিমাণ সোনা।
২০১০ সালে প্রথম বার দুবাইয়ে এ ধরনের এটিএম তৈরি করা হয়। দুবাইয়ে সোনা বার করার এটিএমগুলিও সোনা দিয়েই তৈরি। চুরি রোধের জন্য প্রতিটি এটিএম কড়া নজরদারির আওতায় রাখা হয়।
বিলাসবহুল একটি দ্বীপ তৈরি করেছে দুবাই প্রশাসন। ৬ বছর ধরে এবং ১২০০ কোটি ডলার ব্যয় করে এই দ্বীপ তৈরি করা হয়েছে। নাম ‘পাম দ্বীপপুঞ্জ’। হোটেল, রেস্তরাঁ, বিলাসবহুল আবাসন থেকে শুরু করে উন্নতমানের প্রযুক্তি, কী নেই সেই দ্বীপে!
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কৃত্রিম সেই দ্বীপ তৈরিতে যে বালি ব্যবহৃত হয়েছে, তা দিয়ে পৃথিবীর পরিধি বরাবর একটি দু’মিটারের প্রাচীর তোলা সম্ভব। পাম দ্বীপপুঞ্জের আয়তন প্রায় ৬০০টি প্রাণ আকারের ফুটবল মাঠের সমান।
দুবাইয়ের স্থানীয় শেখদের ঘরে ঘরে চিতা এবং বাঘ পোষার চল রয়েছে। তবে সেই পোষা চিতা বা বাঘের হামলায় যদি কেউ আহত বা নিহত হন, তা হলে তাদের মালিককে মোটা টাকা দিতে হয়।
দুবাই এমন একটি শহর যেখানে ভোজ্য সোনায় মোড়া মিষ্টি এবং অন্যান্য খাদ্য পাওয়া যায়। বিশ্বের সবচেয়ে দামি কেক এবং মিষ্টি পাওয়া যায় এই শহরেই।