পশ্চিম এশিয়ায় ক্রমশ ভয়ঙ্কর হচ্ছে পরিস্থিতি। ইজ়রায়েলের সঙ্গে এ বার সম্মুখসমরে জড়াল ইরান। ইহুদি দেশটির উপর লাগাতার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে পারস্য উপসাগরের শিয়া রাষ্ট্র। ইজ়রায়েল পাল্টা প্রত্যাঘাত শুরু করলে যুদ্ধ যে আরও ভয়াবহ রূপ নেবে, তা বলাই বাহুল্য।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা নিয়ে ২ অক্টোবর এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) একটি পোস্ট করে ইহুদিদের বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার। সেখানে বলা হয়েছে, মোট ১৮১টি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আক্রমণ চালিয়েছে তেহরান। তবে তাতে একজন নাগরিকেরও মৃত্যু হয়নি।
ক্ষেপণাস্ত্র বা রকেট হামলা থেকে বাঁচতে ইজ়রায়েল জুড়ে রয়েছে শয়ে শয়ে ‘বম্ব শেল্টার’। ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইহুদি দেশটির আকাশসীমা লঙ্ঘন করতেই নাগরিকদের সেই সব আশ্রয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয় বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার। যার জেরে প্রাণহানি ঠেকানো গিয়েছে বলে জানিয়েছে ইহুদি প্রশাসন। এই হামলায় বেশ কয়েক জন ইজ়রায়েলির আহত হওয়ার খবর এসেছে।
অন্য দিকে, ইহুদিদের উপর হামলার কারণ ব্যাখ্যা করেছে শিয়া রাষ্ট্রের প্রশাসন। তেহরান জানিয়েছে, ইরানি সেনাবাহিনীর (ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কর্পস বা আইআরজিসি) পদস্থ কর্তা ও দেশের অন্যান্য নেতাদের বেছে বেছে খুন করছে ইজ়রায়েল। আর তাই তাঁদের শিক্ষা দিতে পাল্টা এই হামলা চালানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের অবশ্য দাবি, হিজ়বুল্লা প্রধান সৈয়দ হাসান নাসরাল্লার হত্যার বদলা নিতেই ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইজ়রায়েলের উপর হামলা চালিয়েছে ইরান। তেহরানের ‘তৈরি করা’ শিয়াপন্থী এই জঙ্গি সংগঠনের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা লুকিয়ে ছিলেন ইহুদিদের প্রতিবেশী দেশ লেবাননে। দিন কয়েক আগে ইজ়রায়েলের হানায় প্রাণ গিয়েছে তাঁর।
ইজ়রায়েল সরকারের দাবি, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সময় ১০ লক্ষ নাগরিককে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে তাঁদের সেখান থেকে বার করে আনা হয়। ওই ঘটনার পর পারস্য উপসাগরের শিয়া দেশটিকে খোলাখুলি হুমকি দিয়েছেন ইহুদি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
হুঁশিয়ারির সুরে ইজ়রায়েল বলেছে, ‘‘ইরান বড় ভুল করে ফেলেছে। এর ফল ওদের ভুগতেই হবে।’’ ইহুদি দেশটির এ হেন রণং দেহি মূর্তি দেখে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা। কী ভাবে ইজ়রায়েল প্রত্যাঘাত হানবে তা নিয়ে বিশ্ব জুড়ে শুরু হয়েছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
ইজ়রায়েলি ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফের কাছে রয়েছে আমেরিকার তৈরি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান। যা দিয়ে তাঁরা ইরানের খনিজ তেলের ঘাঁটি উড়িয়ে দিতে পারে বলে মনে করছেন সমর বিশেষজ্ঞেরা। কেউ কেউ আবার তেহরানের হাতে থাকা রাশিয়ার এস-৩০০ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম ধ্বংসের ব্যাপারে বাজি ধরেছেন। এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার একটি ইউনিটকে কয়েক মাস আগেও একবার উড়িয়েছে আইডিএফ।
এর মধ্যেই আবার প্রাক্তন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেফটালি বেনেট ইরানের পরমাণু অস্ত্র তৈরির যাবতীয় গবেষণা ও প্রস্তুতিকে পুরোপুরি নষ্ট করার পক্ষে সওয়াল করেছেন। বিশেষজ্ঞদের অবশ্য দাবি, ইহুদিদের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের দেওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে প্রত্যাঘাত শানাবে নেতানিয়াহুর ফৌজ। যা সামলানোর ক্ষমতা নেই ইরানের।
মোসাদের জাল যে পারস্য উপসাগরের তীরের শিয়া দেশটির ভিতরে কী ভাবে ছড়িয়ে রয়েছে, নাসরাল্লার মৃত্যুর পর তা নিয়ে বিস্ফোরক তথ্য দিয়েছেন প্রাক্তন ইরানি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমদিনেজাদ। তাঁর দাবি, ইজ়রায়েলকে ঠেকাতে তেহরানের যে গুপ্তচর সংস্থা রয়েছে, তার প্রধানই ইহুদিদের হয়ে চরবৃত্তি করেছেন।
সম্প্রতি তুরস্কে আমেরিকার সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে সাক্ষাৎকার দেন আহমেদিনেজাদ। সেখানেই মোসাদকে নিয়ে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন তিনি। তাঁর দাবি, ২০২১ সালের মধ্যে এটা স্পষ্ট হয়েছিল যে তেহরানের গুপ্তচর বিভাগের প্রধান ইজ়রায়েলের হয়ে কাজ করছেন।
প্রাক্তন ইরানি প্রেসিডেন্ট সিএনএনকে বলেছেন, ‘‘ইহুদিরা আমাদের দেশের ভিতরে অনায়াসেই জটিল অভিযান চালাতে পারে। এর জন্য যে তথ্যের প্রয়োজন, সেটা পাওয়া ইজ়রায়েলের কাছে একেবারেই কঠিন নয়। আশ্চর্যজনক ভাবে সব জেনেও তেহরান এ ব্যাপারে নীরব। যা বিপদের কারণ হতে পারে।’’
আহমেদিনেজাদের দাবি, এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ইরানি গুপ্তচর বাহিনীতে এমন ২০ জন এজেন্ট রয়েছেন, যাঁরা ইহুদিদের হয়ে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। ‘‘এই ডাবল এজেন্টরাই ইজ়রায়েলকে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির সংবেদনশীল তথ্য তুলে দিয়েছে। ২০১৮ সালে ওই নথি চুরির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত ছিলেন তাঁরা।’’ সিএনএনকে বলেছেন আহমেদিনেজাদ।
ইরান পরমাণু হাতিয়ার তৈরির উদ্যোগী হওয়ার প্রথম দিন থেকেই তাতে বাধা দিয়ে আসছে ইজ়রায়েল। এই কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত একাধিক ইরানি গবেষকের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। যার নেপথ্যে ইহুদি দেশটির গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের হাত রয়েছে বলেই মনে করে ওয়াকিবহাল মহল।
প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আহমেদিনেজাদ জানিয়েছেন, ইরানি পরমাণু গবেষকদের খুনে মোসাদকে প্রত্যক্ষ ভাবে সাহায্য করেছেন ইরানের ডাবল এজেন্টরা। সেপ্টেম্বরেই শিয়া মুলুকটিতে গিয়ে আইআরজিসির পদস্থ কর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন হিজ়বুল্লা প্রধান নাসরাল্লা। ওই সময় তাঁর গতিবিধির খবর ডাবল এজেন্টদের থেকে পেয়েছিল মোসাদ। সেই মতো নাসরাল্লা লেবাননের রাজধানী বেইরুটে ফিরতেই বিমান হামলা চালায় আইডিএফ।
আহমেদিনেজাদের এ হেন বিস্ফোরক মন্তব্যের প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছে ইরানের প্রাক্তন গোয়েন্দামন্ত্রী আলি ইউনেসির গলায়। তাঁর কথায়, ‘‘ইজ়রায়েলি গুপ্তচরেরা ইসলামীয় প্রজাতন্ত্রের ক্ষমতায় শীর্ষে বসে রয়েছে। ফলে চক্রান্ত করতে সুবিধা হচ্ছে তাঁদের।”
২০২১ সালের একটি সাক্ষাৎকারে ইউনেসি বলেন, ‘‘গত ১০ বছরে ইরানের একাধিক সরকারি দফতরে মোসাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ফলে দেশের শীর্ষ আধিকারিকদের প্রাণের ঝুঁকি বেড়ে গিয়েছে।’’
চলতি বছরের ৩১ জুলাই তেহরানে একটি বিস্ফোরণে প্রাণ হারান ইরান সমর্থিত জঙ্গি সংগঠন হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়ে। যার নেপথ্যে মোসাদের হাত রয়েছে বলে মনে করা হয়। হানিয়ের মৃত্যুর দু’মাসের মধ্যেই নাসরাল্লাকে খতম করেছে আইডিএফ। এই অবস্থায় ইজ়রায়েলি হামলার আশঙ্কা থাকায় দেশের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লা খোমেইনিকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে তেহরান প্রশাসন।