রাজা নন, রাজকর্মচারী! তবু রাজকীয় সমাধি! ৪০০০ বছরের পুরনো মমি প্রকাশ্যে আনল মিশর।
এ বার সেই মিশরেই জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হল দেশের অন্যতম প্রাচীন একটি সমাধিক্ষেত্রকে। তবে এই সমাধিক্ষেত্রে কোনও রাজা বা ফ্যারাও শায়িত নেই। সমাধিক্ষেত্রটি প্রায় ৪০০০ বছরের পুরনো বলে জানা গিয়েছে।
সমাধিক্ষেত্রটিতে শায়িত রয়েছেন মেরু নামের এক রাজকর্মচারী। মিশরের ইতিহাস নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁরা জানাচ্ছেন, মেরু ছিলেন মিশরের একাদশতম রাজবংশের রাজা দ্বিতীয় মেনটুহোটেপের ঘনিষ্ঠ, এক উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী।
যে জায়গা থেকে সমাধিক্ষেত্রটি আবিষ্কৃত হয়েছিল, সেই উত্তর আসাসিফ এমনিতে অনালোচিত একটা জায়গা। খুব বেশিও মমি এই চত্বরে নেই। তাই লাক্সর শহরের পশ্চিমে এই জায়গায় পর্যটকদের ভিড় তুলনামূলক ভাবে কমই থাকে।
মেরুর সমাধি যেখা্নে আবিষ্কৃত হয়েছে, তার কিছুটা দূর থেকেই পাওয়া গিয়েছে ফ্যারাও দ্বিতীয় মেনটুহোটেপের সমাধি। মেনটুহোটেপ খ্রিস্টপূর্ব ২০০৪ সাল পর্যন্ত মিশরে রাজত্ব করেছিলেন।
তাঁর আমলেই গৃহযুদ্ধ থামে সে দেশে। সে সময় মিশরের কোনও নির্দিষ্ট ভৌগোলিক কিংবা রাজনৈতিক আকৃতি না থাকলেও সেই সময় দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার কৃতিত্ব কেউ কেউ দ্বিতীয় মেনটুহোটেপকে দিয়ে থাকেন।
মেরুর সমাধিটি দ্বিতীয় মেনটুহোটেপের নামাঙ্কিত মন্দিরে ঢোকার ঠিক আগেই পাওয়া গিয়েছে। সমাধির সামনে উপাসনা করার জন্য একটি প্রশস্ত চত্বরও রয়েছে।
তা ছাড়াও মৃত ব্যক্তির মূর্তি রাখার জন্য একটু কুলুঙ্গির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। আর একটু এগোলেই দেখা যাচ্ছে, একটি অগভীর গর্তের ভিতর বিশেষ আয়তাকার শবাধারের মধ্যে সংরক্ষিত রয়েছে মমিটি।
প্রত্নতত্ত্ববিদদের সূত্রে জানা গিয়েছে, মেরুর সমাধিক্ষেত্রটিতে একটি মাত্র ঘর রয়েছে। তবে ঘরটি যথেষ্ট সাজানো-গোছানো বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
ঘরটির মধ্যে যে অলঙ্করণ রয়েছে, তা সেই সময়কার অন্য সমাধির তুলনায় একেবারেই অন্য রকম বলে জানিয়েছেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা।
তাঁরা জানাচ্ছেন সেই সময়ের বেশ কিছু রাজকর্মচারীকে উত্তর আসাসিফে সমাধি দেওয়া হয়েছে। যেখান থেকে অনেকের অনুমান, এ সময় রাজার সঙ্গে উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের ভাল সম্পর্ক ছিল এবং কর্মচারীরা যথেষ্ট ক্ষমতা এবং স্বাধীনতা ভোগ করতেন।
তবে উত্তর আসাসিফেই রয়েছে মিশরের ‘রহস্যময়ী’ রানি হাটসেপসুট এবং তাঁর স্বামী, ফ্যারাও তৃতীয় থুটমোসের সমাধি। মধ্যযুগে নারী হয়েও হাটসেপসুট যে ভাবে বীরত্বের সঙ্গে সাম্রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন, তা এখনও চর্চার বিষয়বস্তু হয়ে আছে।
মেরুর সমাধিটির খোঁজ অবশ্য মিলেছিল বেশ কিছু বছর আগেই। পরে সেটির রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচর্যা করেন পোল্যান্ডের ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদরা। তাঁদের সহযোগিতা করেন মিশরের পুরাতত্ত্ব বিভাগ।
মিশরের পুরাতত্ত্ব বিভাগের জেনারেল ডিরেক্টর ফাতি ইয়াসিন এই প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয়-চতুর্থ শতাব্দীর সমাধিক্ষেত্র থিবস অঞ্চল থেকে প্রথম কোনও সমাধি উদ্ধার এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা গিয়েছে।
থিবস হচ্ছে প্রাচীন মিশরের গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর। শহরটি ভূমধ্যসাগরের ৮০০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত ছিল।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে মেরুর এই সমাধির কথা প্রথম জানা যায়। পরে ইটালি, পোল্যান্ড এবং মিশরের প্রত্নতাত্ত্বিক দল একত্রে সমাধিক্ষেত্রটির সংস্কার করে।
সংস্কার করার সময় কোনও প্রাচীন জিনিস যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তা মাথায় রাখা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে মেরুর সমাধিক্ষেত্রটির ভিতরে যে দেওয়ালচিত্র আছে, তা পরিষ্কার করা হয়। তার পর সমাধিক্ষেত্রটির আকর্ষণ আরও বেড়ে যায়।
এত দিন ওই অঞ্চলে দ্বিতীয় মেনটুহোটেপের মন্দির এবং সেটির অনুকরণে তৈরি হাটসেপসুটের মন্দিরটিই ছিল দর্শকদের কাছে মূল আকর্ষণ। এ বার তার সঙ্গে যুক্ত হল মেরুর সমাধিক্ষেত্রটিও।
দীর্ঘ দিন ধরে গৃহযুদ্ধ, সামরিক অভ্যত্থানের পরে সাময়িক স্থিতি ফিরে এসেছে মিশরে। সে দেশের প্রশাসন চাইছে মিশরের প্রাচীন রহস্যে পর্যটকদের আকৃষ্ট করে পর্যটন শিল্প থেকে আরও বেশি করে উপার্জন করতে।