নব্বইয়ের দশকের জাপান কি ফিরতে চলেছে চিনেও? অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান দেখে চিনা বিশেষজ্ঞেরা তেমনই আন্দাজ করছেন। সিঁদুরে মেঘ ঘনিয়েছে বেজিংয়ের অর্থনীতির আকাশে।
করোনা অতিমারির পর থেকে চিনের অর্থনীতিতে যেন মোড় ঘুরে গিয়েছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে কোনও হ্রাস-বৃদ্ধি নেই। যেন অপার স্থবিরতা গ্রাস করেছে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের দেশকে।
অতিমারিতে চিন সরকার সারা দেশে কঠোর ভাবে কোভিডবিধি প্রয়োগ করেছিল। লকডাউনের কারণে থমকে ছিল স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। সেই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার পর চিনা জনগণের চেনা স্বভাবও খানিক বদলে গিয়েছে।
তিন বছর লকডাউনে ডুবে ছিল চিন। তার পর স্বাভাবিক জীবনযাত্রার কয়েক মাস পর্যবেক্ষণে দেখা গিয়েছে, চিনের শহর এবং গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দারা অধিক সঞ্চয়ী হয়ে উঠেছেন।
অর্থাৎ, চিনারা আজকাল আর বেশি খরচ করতে চাইছেন না। তাঁরা টাকা জমাচ্ছেন। দৈনন্দিন জীবন থেকে তাঁরা অনাবশ্যক বিলাসিতা ছেঁটে ফেলেছেন। যেটুকু না হলেই নয়, তার ব্যবস্থা করে বাকি অর্থ রেখে দিচ্ছেন ভবিষ্যতের ভাঁড়ারে।
চিন সরকার নাগরিকদের ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দিতে পারেনি বলেই কি এই সঞ্চয়ের প্রবণতা? অর্থনীতিবিদদের একাংশ তেমনটাই মনে করছেন। নাগরিক জীবনের উন্নতির দিকে সরকারের ঔদাসীন্য ছিলই, অতিমারি তাতে ঘি ঢেলেছে যেন।
অতিমারি পরিস্থিতি চিনে সার্বিক ভাবে একটি অনিশ্চয়তার আতঙ্ক তৈরি করেছে। মানুষ খরচ করতে ভয় পাচ্ছেন। ভবিষ্যতে হঠাৎ চাকরি হারালে বা বড় কোনও অসুখবিসুখ করলে কে অর্থ জোগাবে? এই চিন্তা এখন চিনাদের সর্ব ক্ষণের সঙ্গী।
চিনাদের এই সঞ্চয়ের প্রবণতাই দেশের অর্থনীতিকে সঙ্কটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। মানুষ জিনিস কিনতে চাইছেন না। ফলে পণ্য উৎপাদিত হলেও বিক্রি হচ্ছে না। বাজারে চাহিদা কমে গিয়েছে।
এই চাহিদা হ্রাসের কারণে চিনে অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। জিনিসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার বদলে ক্রমশ কমছে। থেকে যাচ্ছে প্রচুর উদ্বৃত্ত। এই পরিস্থিতিকে ‘মুদ্রাসঙ্কোচন’ বলা হচ্ছে। যা বাস্তবে মুদ্রাস্ফীতির বিপরীত অবস্থা।
চিনের অর্থনীতি এত দিন মূলত নির্মাণশিল্প, জমিজমার রাজস্বের উপর নির্ভর করে ছিল। সেই খাতেই সরকার বিনিয়োগ করত। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার দিকে তাদের হুঁশ ছিল না। অতিমারির পর সেই নির্মাণশিল্প ধাক্কা খাওয়ায় টনক নড়েছে জিনপিংয়ের।
অর্থনীতির সাম্প্রতিক পরিস্থিতি দেখে তড়িঘড়ি পদক্ষেপ শুরু করেছে বেজিং। গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিসে ভর্তুকি ঘোষণা করা হয়েছে। রেস্তরাঁ, সিনেমা হলের মতো বিনোদনমূলক দিকগুলিতে ব্যয় করছে সরকার। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের একাংশের প্রশ্ন, দেরি হয়ে যায়নি তো?
কেউ কেউ চিনের এই পরিস্থিতির সঙ্গে নব্বইয়ের দশকের জাপানের তুলনা টানছেন। জাপানের সেই অর্থনৈতিক অবস্থাকে বলা হয় ‘লস্ট ডিকেড’। জাপানের অর্থনীতিও এমন হোঁচট খেয়েছিল।
১৯৯১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত জাপানের অর্থনীতি ‘লস্ট ডিকেড’-এর মধ্যে ছিল। ওই সময়ে দেশটির অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হয়েছিল মাত্র ১.১৪ শতাংশ। অর্থাৎ, জাপানের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছিল। না হয়েছিল অবনতি, না ছিল কোনও উন্নতি।
চিনের পরিস্থিতিও সে দিকেই এগোচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে। অর্থনীতিতে কোনও গতিশীলতা নেই। আর্থিক বৃদ্ধি হচ্ছে না। আবার বড় কোনও পতনও চোখে পড়ছে না।
সার্বিক ভাবে জিনপিং সরকারের উপর বীতশ্রদ্ধ এবং বিরক্ত চিনের অধিকাংশ মানুষ। সরকারের উপর ভরসা করতে পারছেন না তাঁরা। এই ভরসা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে জিনপিংকে।
পরিসংখ্যান বলছে, চিনে কোনও সাধারণ মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবীর মাসিক বেতন আমেরিকার পাঁচ ভাগের এক ভাগও নয়। নাগরিকদের অধিক বেতন দিয়ে জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের কথা কখনও ভাবেইনি চিন সরকার।
বেসরকারি ক্ষেত্রেও ছবিটা প্রায় একই। অতিমারি চলাকালীন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধাক্কা খেয়েছে। তারাও কর্মীদের বেতন বৃদ্ধি করতে পারছেন না। মানুষের সঞ্চয়ের দিকে ঝোঁকার অন্যতম কারণ এটাও।
অতিমারির পরে চিনের অন্যতম বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বেকারত্ব। তরুণ প্রজন্ম চাকরি হারাচ্ছেন। রোজগারের নতুন উপায় খুঁজতে কালঘাম ছুটছে তাঁদের। পরিসংখ্যান বলছে, এই মুহূর্তে দেশের তরুণদের ২১ শতাংশ কর্মহীন।
ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা না থাকায় সংসার পাততেও ভয় পাচ্ছেন চিনের তরুণ প্রজন্ম। তাঁরা বিয়ে করা বা সন্তান পালন করার ইচ্ছা হারিয়েছেন। ফলে চিনে বয়স্কদের সংখ্যা বাড়ছে, কমে আসছে তারুণ্যের পরিমাণ।
কোনও দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে হলে দায়িত্ব নিতে হয় তরুণদেরই। সেই তারুণ্যে ঘাটতি চিনের অর্থনীতির পক্ষে মোটেই শুভ লক্ষণ নয়। এখন থেকে হাল না ধরলে আগামী দিনে চিনের অর্থনীতি স্থবিরতায় ডুবে যাবে।
চিনা অর্থনৈতিক সঙ্কটের অনিবার্য প্রভাব পড়বে অন্য দেশগুলির উপরেও। কারণ, চিন এখনও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। তাদের উপর অনেক দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি নির্ভর করে থাকে। অতিমারির ধাক্কা দ্রুত কাটিয়ে উঠুন জিনপিং, সেই আশাতেই দিন গুনছেন অর্থনীতিবিদেরা।