কে বসবেন পাকিস্তানের কুর্সিতে? নির্বাচনের ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও উত্তর অজানাই। পাকিস্তানের দ্বাদশ সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল এখনও আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করেনি সে দেশের নির্বাচন কমিশন। সব ক’টি কেন্দ্রের ভোটগণনাও এখনও শেষ হয়নি।
নির্বাচন কমিশনের তরফে জানানো হয়েছে, বেশ কিছু এলাকায় যান্ত্রিক গোলযোগ এবং ইন্টারনেট পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় গণনায় দেরি হচ্ছে। কোথাও কোথাও জঙ্গি হামলাও ভোটের কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে।
গণনার শেষ লগ্নে এসে অনেকেই মনে করছেন, ভোটের পিচে পাকিস্তানের দুই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ‘সুপার ওভার’-এ পৌঁছে গিয়েছেন। এখন কী হবে, অপেক্ষায় গোটা পাকিস্তান।
পাক ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে এখন মোট আসন ৩৩৬। কিন্তু তার মধ্যে সরাসরি ভোট হওয়ার কথা ছিল ২৬৬টি আসনে। এক প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে ২৬৫টি আসনে ভোট হয়েছে। বাকি ৭০টি আসন মহিলা এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে।
নানা রকম সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে পাকিস্তানের নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে। পাকিস্তানে সরকার গড়তে প্রয়োজন ১৬৯টি আসন। পাক সংবাদমাধ্যম ‘ডন’-এর তথ্য অনুযায়ী, এখনও পর্যন্ত পিটিআই সমর্থিত নির্দল প্রার্থীরা ৯৩টি, আর এক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পিএমএল-এন ৭৩টি আসনে জয়লাভ করেছে।
অন্য দিকে প্রথম দিকে প্রায় সমানে সমানে টক্কর দিলেও পরে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে বিলাবল ভুট্টোর দল পিপিপি। ওই সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী ৫৪টি আসনে জিতেছে পিপিপি। অন্যান্যরা পেয়েছে ৩৩টি আসন।
অন্য একটি সূত্র বলছে, পিটিআই সমর্থিত নির্দলরা ১০২টি আসনে জয়ের মুখ দেখে ফেলেছেন। তবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গড়ার জন্য চাই আরও ৩১টি আসন। যা সম্ভব নয়। কারণ আর গুটিকয়েক আসনে গণনা বাকি আছে।
ইমরান এবং নওয়াজ, দু’জনেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গড়ার দাবি জানিয়েছেন। তবে নির্বাচন কমিশন এখনও পূর্ণাঙ্গ ফল ঘোষণা করেনি। মনে করা হচ্ছে, এখনও ৮ থেকে ১০টি কেন্দ্রে ভোটগণনা বাকি।
ইতিমধ্যে অনেক কেন্দ্র থেকে প্রার্থীরা গণনায় কারচুপির অভিযোগ জানিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন ৪০টি কেন্দ্রে ইতিমধ্যে পুনর্নিবাচনের নির্দেশ দিয়ে দিয়েছে। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি পুনর্নিবাচনের দিন স্থির হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, পাকিস্তানের রাজনীতিতে আগামী কয়েক দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে।
এই সময়ের মধ্যেই হতে পারে রাজনৈতিক দলগুলির ‘ঘোড়া কেনাবেচা’র খেলা। যা তুরুপের তাস হয়ে উঠবে পূর্ণাঙ্গ ফলাফলে। সরকার কে গড়বে, তা-ও নিশ্চিত হয়ে যাবে এই পর্বেই।
ইমরান সমর্থিত নির্দলরা প্রাথমিক ভাবে বেশি আসন পেলেও ‘সুপার ওভারে’ খেলা অন্য দিকে ঘুরে যেতে পারে।
ইমরানের দলকে রুখতে নওয়াজের সঙ্গে বিলাবল ভুট্টোর পিপিপি হাত মেলাতে চলেছে বলে আগেই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। পিপিপি সিন্ধ প্রদেশে শক্তিশালী। সেখান থেকেই মূলত ভোট পেয়েছেন তিনি।
তাঁদের জোট হলে পাকিস্তানে জোট সরকার গঠন করবে নওয়াজের পিএমএল-এন। আবার দেশের সেনাবাহিনীর সমর্থনও রয়েছে তাঁর পক্ষে।
দেশের ‘সব থেকে ক্ষমতাশালী’ সেনাবাহিনীর প্রধান দেশবাসীর উদ্দেশে বার্তা দিয়েছেন, ‘‘পাকিস্তানের রাজনৈতিক বহুত্বকে তুলে ধরতে প্রয়োজন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত জোট সরকারই।’’
কোন কোন দল এই ‘জোট সরকার’ গঠন করবে সে বিষয়ে সেনাপ্রধান মুখ না খুললেও নির্বাচনের আগে থেকেই দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলে আসছেন, এ বার সেনার ‘পছন্দের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী’ পিএমএল(এন) সর্বেসর্বা নওয়াজ় শরিফ।
এর আগে নওয়াজ় নিজেই বলেছিলেন, পিপিপি-সহ বিভিন্ন দলের সঙ্গে জোট সরকারের বিষয়ে তাঁরা কথাবার্তা ইতিমধ্যেই শুরু করে দিয়েছেন।
তার পর পাক সেনাপ্রধান সৈয়দ আমির মুনিরের তরফে প্রকাশিত এক বার্তায় বলা হয়েছে, ‘‘নির্বাচনের লক্ষ্য হচ্ছে দেশের মানুষের সেবা করা। এটা কোনও প্রতিযোগিতা নয়। পাকিস্তানের মানুষ সংবিধানে আস্থা রেখেছেন। এ বার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলেরও উচিত, সংগঠিত ভাবে সরকার গঠনে উদ্যোগী হওয়া। ২৫ কোটি মানুষের এই দেশের প্রগতির জন্য এই ঐক্যের প্রয়োজন।’’
তবে পিএমএল(এন), পিপিপি এবং জেইউআই-এফ জোট বাঁধলেও এখনও পর্যন্ত ম্যাজিক নম্বরের অনেক দূরে তারা। দলীয় সূত্রের খবর, সে জন্যই অন্যান্য ছোট দল বা নির্দল প্রার্থীদের সমর্থন জোগাড় করতে ইতিমধ্যেই সচেষ্ট হয়েছেন দলের নেতারা।
এর আগে শুক্রবার রাতে ভোটগণনার প্রবণতার আঁচ মেলার পরেই বৈঠকে বসেছিলেন বিলাবলের বাবা তথা প্রাক্তন পাক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি এবং শরিফ।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। পিপিপি-এর প্রধান বিলাবল ভুট্টোর দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে এই জোট নিয়েও। আজ একটি পাক সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিলাবল দাবি করেছেন, এখনও পর্যন্ত কোনও দলের সঙ্গে তাঁদের জোট সরকার গঠন করা নিয়ে কথা হয়নি।
গত কাল তাঁর বাবা আসিফ আলি জ়ারদারির সঙ্গে নওয়াজ়ের বৈঠকের খবর কি তা হলে ভুল? বিলাবলের জবাব, ‘‘এ বিষয়ে মন্তব্য করার মতো পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি।’’
প্রসঙ্গত, দুর্নীতির দায়ে জেল খাটছেন ইমরান। তাঁর দলের প্রতীকে এ বার কেউ ভোটেও দাঁড়াতে পারেননি। পিটিআই সমর্থিত প্রার্থীরা তাই পাকিস্তানে নির্দল হিসাবে লড়ছেন।
জেল থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে ‘বিজয় ভাষণ’ দিয়েছেন ইমরান খান। আগে রেকর্ড করা এই বক্তৃতায় ইমরান দেশের মানুষকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘‘আপনাদের ব্যালট যা বলেছে, তা বাস্তবে রূপায়িত করতে আপনাদেরই এগিয়ে আসতে হবে।’’
পিটিআইয়ের তরফে আজও দাবি করা হয়েছে, সরকার গড়বে তারাই। এবং কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, ইমরানই তা ঠিক করে দেবেন। তবে বাস্তবে পড়শি দেশের কুর্সিতে কে বসবেন? তার উত্তর দেবে সময়।