Trump on NATO

নেটো ছাড়বে আমেরিকা? ঠান্ডা যুদ্ধের আমলের চুক্তিতে ‘বিষ নজর’ দিয়ে হুমকি দিলেন ট্রাম্প

কানাডা ও ইউরোপীয় দেশগুলির সঙ্গে থাকা ৭৫ বছরের পুরনো নেটো থেকে বেরিয়ে আসার হুমকি দিলেন আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তাঁর এ হেন ঘোষণায় প্রশ্নের মুখে দুনিয়ার শক্তির ভারসাম্য।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৪:০৫
Share:
০১ ২০

নির্বাচিত হওয়া ইস্তক একের পর এক বোমা ফাটিয়ে চলেছেন তিনি। এ বার ৭৫ বছর ধরে চলা সৈন্যচুক্তির উপর ‘কুদৃষ্টি’ পড়েছে তাঁর। এক ঝটকায় সেই সামরিক সমঝোতাকে লোকসানের খাতায় ফেলে সেখান থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিলেন ‘সুপার পাওয়ার’ দেশের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। আর তাঁর মনমর্জির হদিস মিলতেই তোলপাড় পড়ে গিয়েছে সারা দুনিয়ায়।

০২ ২০

২১ শতকের প্রথমার্ধে প্রশ্নের মুখে পড়া এই সৈন্যচুক্তির নাম ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংগঠন’ (নর্থ আটলান্টিত ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) বা নেটো। সামরিক সমঝোতাটিকে বর্তমানে বিষ নজরে দেখছেন আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। অথচ নেটোর ‘প্রাণভোমরা’ লুকিয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফৌজি ক্ষমতায়। শুধু তাই নয়, ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ চলাকালীন ১৯৪৯ সালে ট্রাম্পের পূর্বসূরি হ্যারি ট্রুম্যানই ছিলেন এই প্রতিরক্ষা চুক্তির অন্যতম রূপকার।

Advertisement
০৩ ২০

কেন হঠাৎ ৩২ দেশের সৈন্যচুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন ট্রাম্প? এর নেপথ্যে সামরিক ব্যয় বরাদ্দকেই মূলত দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞেরা। যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বার নির্বাচিত বর্ষীয়ান রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের গলাতেও সেই সুর শোনা গিয়েছে। নেটোভুক্ত দেশগুলির সামরিক ব্যয় বরাদ্দ নিয়ে ভোট প্রচারেও প্রশ্ন তোলেন তিনি।

০৪ ২০

ট্রাম্পের অভিযোগ, নেটোভুক্ত দেশের অধিকাংশই তাঁদের বৈদেশিক নিরাপত্তার বিষয়টি পুরোপুরি আমেরিকার উপর ছেড়ে দিয়েছে। ফলে এতগুলি রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত খরচের ভার বইতে হচ্ছে ওয়াশিংটনকে। এই অবস্থার বদল না হলে ওই চুক্তি ছেড়ে বেরিয়ে আসার হুমকি দিয়েছেন তিনি। প্রথম বার ক্ষমতায় থাকাকালীনও এই ইস্যুতে সুর চড়িয়েছিলেন ট্রাম্প।

০৫ ২০

নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের এ হেন মনোভাবে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা আধিকারিকেরা। তাঁদের আশঙ্কা, এর ফলে ইউরোপে দুর্বল হবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব। বিগড়ে যাবে শক্তির ভারসাম্য। আর এর সুযোগ নিয়ে আরও আগ্রাসী হবে রাশিয়া ও চিন। আমেরিকা নেটো ছাড়লে মস্কো যে হাসতে হাসতে ইউক্রেনের দখল নেবে, ইতিমধ্যেই সেই সতর্কবার্তা দিয়েছেন তাঁরা।

০৬ ২০

আমেরিকার গোয়েন্দাকর্তারা যে আশঙ্কাই করুন না কেন, সূত্রের খবর এ ব্যাপারে ‘ধনুকভাঙা পণ’ করেছেন ট্রাম্প। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, অন্য দেশের নিরাপত্তার জন্য কোটি কোটি ডলার খরচ করবে না ওয়াশিংটন। নেটোর অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখতে এর সদস্য দেশগুলিকে তাদের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির দুই শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে খরচ করার শর্ত রেখেছেন তিনি।

০৭ ২০

২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রথম বার প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন নেটোর সামনে একই শর্ত রেখেছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু এই চুক্তিভুক্ত বেশির ভাগ দেশ প্রতিরক্ষা ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেনি। ব্যাপারটা নজরে আসতেই বেজায় চটে যান বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা। পরবর্তী বছরগুলিতে নেটো ত্যাগের সুর জোরালো হতে থাকে ট্রাম্পের গলায়।

০৮ ২০

২০২১ সালে ডোমেক্র্যাটিক নেতা জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে পরিস্থিতির বদল হয়। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে ‘বিশেষ সেনা অভিযান’ শুরু করে রাশিয়া। ফলে পূর্ব ইউরোপে বেঁধে যায় যুদ্ধ। মস্কোর আগ্রাসনে ভয় পেয়ে নেটোয় যোগ দেয় সুইডেন ও ডেনমার্ক। এতে প্রতিরক্ষা খাতে আমেরিকার আর্থিক বোঝা আরও বৃদ্ধি পায় বলে মনে করেন ট্রাম্প।

০৯ ২০

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর নেটোভুক্ত ইউরোপীয় দেশগুলি তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়াতে শুরু করে। নেটোর পদস্থ কর্তারা জানিয়েছেন, অধিকাংশ রাষ্ট্র দুই শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছে। সূত্রের খবর, গত বছর (পড়ুন ২০২৩) এই সৈন্য সমঝোতায় থাকা ১১টি দেশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ জিডিপির দুই শতাংশ করেছে। চলতি আর্থিক বছরে (২০২৪-২৫) ২৩টি দেশের প্রতিরক্ষা বাজেটে একই ছবি দেখা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

১০ ২০

এ ব্যাপারে নেটোর তরফে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবর্ষে (২০২৪-২৫) ইউরোপ এবং কানাডা মিলিয়ে ৪৩ হাজার কোটি ডলার খরচ করছে। অন্য দিকে, গত বছর (পড়ুন ২০২৩) আনুমানিক ৮২ হাজার কোটি ডলার প্রতিরক্ষা খাতে খরচ করেছে একা আমেরিকা। দেশের জিডিপির প্রায় ১৪ শতাংশ এই দিকে ব্যয় করতে পিছপা হয়নি ওয়াশিংটন।

১১ ২০

গত ৮ ডিসেম্বর ‘এনবিসি নিউজ়’-এর ক্রিস্টেন ওয়েলকারের সঙ্গে ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে যোগ দেন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। সেখানেই আগামী চার বছরের কাজের রূপরেখা তুলে ধরেন তিনি। ওই সময়েই প্রথম বার নেটো ছেড়ে বেরিয়ে আসার ইঙ্গিত দেন এই বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা।

১২ ২০

‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে ট্রাম্প বলেন, ‘‘যদি দেখি তাঁরা (চুক্তির অন্যান্য দেশ) যাবতীয় খরচের ভার ঠিকমতো বহন করছে, তা হলে নেটো ছাড়ার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু সেটা না করলে ভাবতে হবে। শর্তপূরণে ব্যর্থ হলে অবশ্যই আমি এই চুক্তি ছেড়ে বেরিয়ে আসব।’’

১৩ ২০

ট্রাম্পের এই মনোভাবের সমালোচনা করেছেন আমেরিকার বিদেশ দফতরের সাবেক কূটনীতিক ও নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসিডেন্ট অ্যাম্বাসাডর ইয়ান কেলি। তাঁর কথায়, ‘‘এত দিন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সামনে একটা শক্তিশালী প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে এসেছে নেটো। সেটা না থাকলে আরও বেশি আগ্রাসী হবে মস্কো।’’ এটা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অনেক বড় ঝুঁকি হতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।

১৪ ২০

বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, আমেরিকার নেটো ত্যাগ ইউরোপের রাজনীতিতে অন্য সমীকরণ তৈরি করতে পারে। মহাদেশটির পশ্চিম পারে রাজনৈতিক ও আর্থিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ‘‘নেটোভুক্ত দেশগুলির সঙ্গে বহু ক্ষেত্রে আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছি। আফগানিস্তানে জয়ের নেপথ্যে এই সৈন্য চুক্তির একটা বড় ভূমিকা ছিল। এ ছাড়া জলদস্যুদের খতম করতে বিগত দশকগুলিতে নেটো বড় ভূমিকা নিয়েছে।’’ বলেছেন ইয়ান কেলি।

১৫ ২০

গত শতাব্দীতে সোভিয়েত-আমেরিকা ‘ঠান্ডা লড়াই’য়ের সময়ে তৈরি হওয়া নেটোর সদর দফতর রয়েছে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে। যদিও এই চুক্তির সইসাবুদ হয়েছিল ওয়াশিংটনে। চুক্তিটিতে বলা রয়েছে, এর কোনও সদস্য রাষ্ট্র অপর কোনও দেশ দ্বারা আক্রান্ত হলে, সমস্ত সদস্য রাষ্ট্র সামরিক দিক থেকে তাকে সাহায্য করতে দায়বদ্ধ থাকবে।

১৬ ২০

ট্রাম্পের নেটো ত্যাগের ইচ্ছার নেপথ্যে তুরস্কের ভূমিকাও কম নয় বলে মনে করেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশ। ইউরোপের ‘অসুস্থ মানুষ’টি নেটোভুক্ত দেশ হয়েও রাশিয়ার থেকে হাতিয়ার আমদানি করা কম করেনি। এ ছাড়া ওয়াশিংটনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে আঙ্কারা। কিন্তু একই সৈন্য জোটে থাকার কারণে ‘সাপের ছুঁচো গেলার’ মতো সবই সহ্য করতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে।

১৭ ২০

বিশেষজ্ঞদের বেশির ভাগই মনে করেন, ট্রাম্পের পক্ষে নেটো ছেড়ে পুরোপুরি বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে বাছা বাছা কয়েকটি দেশকে নিয়ে এই সৈন্যচুক্তি টিঁকিয়ে রাখবেন তিনি। তালিকায় পরমাণু শক্তিধর ব্রিটেন ও ফ্রান্স যে থাকবে তা বলাই বাহুল্য। ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশ জার্মানি এবং ভূমধ্যসাগরের কোলের ইটালিকেও এর মধ্যে রাখতে চাইতে পারেন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট।

১৮ ২০

আমেরিকা নেটো ছাড়লে বা সৈন্যচুক্তিটিকে কলেবরে ছোট করলে সবচেয়ে বিপাকে পড়বে ইউক্রেন। রুশ আক্রমণের সামনে ‘ইউরোপের রুটির ঝুড়ি’র অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখাই দায় হবে। আর সেটা বুঝেই ইতিমধ্যেই ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করছেন সেখানকার প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।

১৯ ২০

সম্প্রতি সংস্কার কাজ শেষে ঐতিহ্যশালী নোত্র দাম গির্জাকে ফের আমজনতার জন্য খুল দিয়েছে ফরাসি প্রশাসন। সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে প্যারিস সফরে যান ট্রাম্প। সেখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা করেন জ়েলেনস্কি। দু’জনের মধ্যে কী কথা হয়েছে, তা অবশ্য প্রকাশ্যে আসেনি।

২০ ২০

বাইডেন প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন রুশ হামলা ঠেকাতে আমেরিকার থেকে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ও হাতিয়ার পেয়ে আসছিল ইউক্রেন। ট্রাম্প তা পুরোপুরি বন্ধ করবেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন। পাশাপাশি, ক্ষমতায় গেলে ইউরোপের যুদ্ধ দ্রুত বন্ধ করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি। সেই লক্ষ্য পূরণের জন্যেই নেটো ত্যাগ করতে চাইছেন রিপাবলিকান নেতা? উত্তর মিলবে সময়ে।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement