ছোট বেলায় বাঙালি মায়ের কাছে তাঁর আটপপৌড়ে বাঙালি দিদার গল্প শুনতেন দিয়া মির্জা। তিনি ছিলেন একজন সাধারণ গৃহবধূ। তবে দিয়ার কাছে অসাধারণ হয়ে উঠতেন তাঁর সিনেমাপ্রেমের জন্য।
হলে গিয়ে সিনেমা দেখবেন বলে নাকি অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় সংসারের সব কাজ গুছিয়ে ফেলতেন সেই মহিলা। গল্প হত সেই সব ঘটনা নিয়েই। দিয়া মন দিয়ে শুনতেন। সিনেমাপ্রেমের সঙ্গে বলিউডের ‘পুতুল’ নায়িকার জানাশোনা সেই সময় থেকেই।
মা দীপা যদিও কোনওদিনই সিনেমায় আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর বিচরণ ক্ষেত্র ছিল তুলি-ক্যানভাসে। কিছুটা সামাজিক সংস্কারের কাজেও। মাদকাসক্তদের মূলস্রোতে ফিরতে সাহায্য করতেন দীপা। নিজে শিল্পী, বিয়েও করেছিলেন এক জার্মান শিল্পীকে। নাম ফ্র্যাঙ্ক হ্যন্ডরিক। দিয়া এই ফ্র্যাঙ্কেরই সন্তান।
১৯৮১ সালের ৯ ডিসেম্বর হায়দরাবাদে জন্ম দিয়ার। এখন তিনি ৪০। এর মধ্যেই ৪২ টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। ছবি প্রযোজনাও করেছেন। ভালবেসে বিয়ে করেছেন আবার বিবাহ বিচ্ছিন্নাও হয়েছেন। আবার প্রেমে পড়েছেন অভিনেত্রী। তার জীবনে বিতর্কও কম নয়। সুন্দরী দিয়াকে অনেক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছ। তাঁর জন্মদিনে সেই ওঠা পড়ার কাহিনীতে একনজর।
ছোট থেকেই নানা কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন দিয়া। জন্মদাতা বাবাকে খুব বেশিদিন কাছে পাননি । তাঁর বয়স যখন সবে সাড়ে চার তখনই ফ্র্যাঙ্ক আর দীপার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। দিয়ার বয়স যখন ন’বছর, তখন ফ্র্যাঙ্ক মারা যান। দীপা অবশ্য তার আগেই দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন।
পরে হায়দরাবাদ নিবাসী এক খানদানি মুসলিমকে বিয়ে করেছিলেন দীপা। নাম আহমেদ মির্জা। এই আহমেদই দিয়ার সৎবাবা। যাঁর পদবি দিয়া জুড়েছিলেন নিজের নামের সঙ্গে।
আহমেদের সঙ্গে দিয়ার সম্পর্ক প্রথম থেকেই ছিল বেশ ভাল। এক সাক্ষাৎকারে দিয়া বলেছিলেন, ‘‘শুধু আমার কথা ভেবেই দ্বিতীয় বিয়েতে সন্তান ধারণ করেননি মা। সেই সিদ্ধান্ত মেনেও নিয়েছিলেন আমার বাবা আহমেদ।’’
দিয়ার মডেলিংয়ে আসা নিয়ে প্রবল আপত্তি তুলেছিলেন তাঁর মা দীপা। তখন আহমেদই সমর্থন জুগিয়েছিলেন দিয়াকে। তাঁরই উৎসাহে দিয়ার মডেলিং কেরিয়ারের শুরু। এমনকি দিয়া মিস ইন্ডিয়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণও করেন আহমেদের সমর্থন পেয়েই।
দীপা চেয়েছিলেন দিয়া আইন নিয়ে বেঙ্গালুরুতে পড়াশোনা করুন। তবে দিয়ার মাথায় তখন জেদ চেপেছে মডেলিংয়ের। ঠিক করেন দুটোই করবেন। কলেজে পড়তে পড়তেই শুরু হয় তাঁর মডেলিংয়ের কাজ। লিপটন, ওয়ালস আইসক্রিম, ইমামির মতো ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনের কাজ পেতে শুরু করেন।
কলেজে পড়াশোনা করতে করতেই মার্কেটিং এগজিকিউটিভ হিসেবেও কাজ শুরু করেন। তখন মাসে ৫০০০ টাকা বেতন পেতেন দিয়া। সেখান থেকেই মিস ইন্ডিয়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ। তাতে তৃতীয় স্থান অধিকার করে মিস এশিয়া প্যাসিফিকে জয়। ওই বছরই বিশ্বসুন্দরী হয়েছিলেন প্রিয়াঙ্কা চোপড়া। ব্রহ্মাণ্ডসুন্দরী হয়েছিলেন লারা দত্ত। দিয়া মিস এশিয়া প্যাসিফিক হওয়ার পরই তাঁর কাছে একের পর এক সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করে।
দিয়া অবশ্য তখনও ভাবেননি অভিনয় করবেন। বেশ কিছু ছবির প্রস্তাব ফিরিয়েও দিয়েছিলেন। বদলে একটি মিউজিক ভিডিয়োয় অভিনয় করেন। এরপরই প্রথম ছবি ‘রেহনা হ্যায় তেরে দিল মে’ করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথম ছবিতেই গোটা ভারত চিনে গিয়েছিল তাঁকে।
এরপর ‘দিওয়ানাপন’, ‘তুমকো না ভুল পায়েঙ্গে’, ‘দম’-এর মতো একের পর এক হিট উপহার দেন বলিউডকে। সব মিলিয়ে ৪২টি ছবি করেছেন কেরিয়ারে। কিন্তু দিয়ার কেরিয়ারের গ্রাফ হঠাৎই থমকে যায়। ২০১৪ সালে অভিনয় ছেড়ে প্রযোজনায় আসেন দিয়া। তৈরি করেন প্রযোজনা সংস্থা বর্ন ফ্রি এন্টারটেনমেন্ট। সঙ্গী হন স্বামী সাহিল সঙ্ঘ।
উদ্যোগপতি সাহিলকে ২০১৪ সালে বিয়ে করেছিলেন। ভালবেসে বিয়ে। তবে বেশিদিন টেকেনি। ২০১৯ সালেই সম্পর্কে ইতি টানেন দু’জনে। দু’বছর পর এখন দিয়া বৈভব রেখির ঘরনি।
পুরনো সম্পর্কের সঙ্গে শেষ হয়েছে পুরনো প্রযোজনা সংস্থাও। তবে প্রযোজক দিয়া থামেননি। তাঁর নতুন প্রযোজনা সংস্থার নাম ‘ওয়ান ইন্ডিয়া স্টোরিজ’।
অভিনেত্রী, প্রযোজক হওয়ার পাশাপাশি নিজের আরও একটি পরিচয় বানিয়েছেন দিয়া। তিনি সমাজকর্মী। পশুদের অধিকার থেকে শুরু করে কৃষকদের স্বার্থ সব বিষয়েই সক্রিয় ভাবে কাজ করেছেন। প্রচারও করেছেন।
শাসক দলের বিরুদ্ধে মুখ খুলে বার বার বিতর্কেও জড়িয়েছেন অভিনেত্রী। মাদার টেরেসাকে নিয়ে মোহন ভাগবতের মন্তব্যের সমালোচনা করে বিজেপি নেতৃত্বের কোপে পড়েন। দিয়া অবশ্য বিজেপি নেতাদের আক্রমণের মুখে মাথা নোয়াননি।
দেশে একদিকে যখন খরার শিকার হয়ে আত্মহত্যা করছেন চাষিরা, তখন দোল উপলক্ষে জলের অপব্যবহার করা নিয়ে সরব হয়েছিলেন অভিনেত্রী। নেট মাধ্যমে তাঁর সেই বক্তব্য তীব্র সমালোচনার শিকার হয়। অভিনেত্রী বাধ্য হন ক্ষমা চাইতে। তবে সেই সঙ্গে এ কথাও জানান, এর সঙ্গে কোনও বিশেষ ধর্মের প্রতি তাঁর বিরাগের কোনও সম্পর্ক নেই। বরং ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে বারবার সরব হয়েছেন দিয়া। বিজেপির আনা সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা সিএএ-র বিরোধিতা করেছেন প্রকাশ্যেই। সমালোচিতও হয়েছেন।
জন্মদাতা বাবা খ্রিস্টান এবং যাঁর পদবি তিনি ব্যবহার করেন তিনি মুসলিম। তবে দিয়া নিজে তাঁর মায়ের হিন্দু ধর্মেরই অনুসারী। বিয়ে করেছেন হিন্দু রীতি মেনেই। যদিও মুখে বারবার বলেছেন, তিনি কোনও বিশেষ ধর্মে বিশ্বাস করেন না। এমনকি দিয়ার সরকারি পরিচয়পত্রেও ধর্মের জায়গাটি ফাঁকা রাখা হয়েছে।
অভিনেত্রীর হাতের উল্কিতে লেখা রয়েছে একটি শব্দ। আজাদ। অর্থাৎ স্বাধীন। অভিনেত্রী জানিয়েছেন তিনি ধর্মীয়, সামাজিক যে কোনও ধরনের গোঁড়ামি থেকে মুক্ত। স্বাধীন।