কালো পোশাক পরলে দুর্দান্ত দেখাত। এমনিতেই স্মার্ট। সুপুরুষ। সুঠাম চেহারা। তার ওপর গায়ের উজ্জ্বল রং আরও ফুটত কালো রঙের বৈপরীত্যে। রাস্তাঘাটে চোখের সামনে ওই রকম একখানা ঝকঝকে চেহারা দেখলে মহিলাকূল নাকি আকছার দুর্ঘটনা ঘটাতেন। ভক্তরা সামলাতে না পেরে বাড়ির ছাদ অথবা বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিয়েছেন, এমন নজিরও রয়েছে। জনপ্রিয়তার বহর দেখে হস্তক্ষেপ করে আদালতও।
এখন মুম্বই, তখনকার বম্বের আদালত তাঁর কালো পোশাক পরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। বলা হয় আর যা-ই পরুন তিনি যেন কালো পোশাক পরে রাস্তায় না নামেন। এক রকম ফতোয়াই বটে। আর ফতোয়াটি যাঁর উদ্দেশে তিনি হলেন ‘গ্রেগরি পেক অব ইন্ডিয়া’। ভারতীয় সিনেমার চিরসবুজ নায়ক। দেব আনন্দ।
তাঁর ছবি ‘কালাপানি’ মুক্তি পাওয়ার পর অভিনেতার জনপ্রিয়তা এমনই তুঙ্গে পৌঁছেছিল যে, নায়কের ব্যক্তিগত জীবন যাপনেও হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়েছিলেন আইনের রক্ষকরা। এমন ঘটনা নজিরবিহীন। বলিউডে সুদর্শন নায়কের কমতি ছিল না। আজও নেই। তবে এঁদের কাউকেই জনপ্রিয়তার বিড়ম্বনা সামাল দিতে পরিধান বদলাতে হয়নি। ঠিক যেমন এঁদের কেউই ‘দ্য এভারগ্রিন’ তকমাও পাননি।
দেব আনন্দ পেয়েছিলেন। তবে তার আগে কঠোর পরিশ্রমও করতে হয়েছিল। এক দিনে সাফল্য আসেনি।
ফিল্মি পরিবারের সন্তান নন। বাবা, বড় দাদা ছিলেন জাঁদরেল আইনজীবী। দেব আনন্দ নিজেও পড়াশোনা করেছেন ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। কিন্তু কলেজে পড়ার সময় হঠাৎই ফিল্মের ভূত মাথায় চাপে। অশোক কুমারের একটি ছবি দেখে অভিনেতা হওয়ার ইচ্ছে হয় তাঁর।
তখন অবশ্য তিনি দেব আনন্দ নন। লাহেৌরের কলেজের কলা বিভাগের ২০ বছরের ছাত্রটিকে ‘ধরম’ বলে ডাকেন বন্ধুরা। পুরো নাম ধরমদেব পিশোরিমল আনন্দ। ৩ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যুদিন।
জন্ম ১৯২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের শাকরগড়ে। এখন অবশ্য সেটি পাকিস্তানে। বাবা পিশোরিমল ছিলেন গুরদাসপুর জেলা আদালতের আইনজীবী। তাঁর পাঁচ সন্তানের মধ্যে তৃতীয় দেব। বাকি তিন ভাই মনমোহন, চেতন এবং বিজয় আনন্দ। এক বোন শিলকান্তার বিয়ে হয় কুলভূষণ কপূরের সঙ্গে। যাঁর একমাত্র সন্তান শেখর কপূর এখন আন্তর্জাতিক চিত্র পরিচালক।
আনন্দ পরিবারে প্রথম সিনেমা বা থিয়েটারে আগ্রহী হন দেব আনন্দেরর দাদা চেতন আনন্দ। চেতন ভবিষ্যতে ফিল্ম প্রযোজক এবং পরিচালক হবেন। তবে তার আগে চল্লিশের দশকের শুরুতে তিনিই প্রথম গুরদাসপুর ছেড়ে বম্বে পা়ড়ি দেন। দেব আনন্দ দাদার কাছে বম্বে পৌঁছন কিছু দিনের মধ্যেই। তার পর থেকেই শুরু লড়াই। পরিচালকের দরজায় গিয়ে নিজেকে পরিচিত করানো। ছবিতে কাজের সুযোগ চাওয়া।
স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান। মুম্বইয়ে গিয়ে দাদার সঙ্গে চওলের ঘুপচি ঘরে থাকতেন নায়ক। কিন্তু শুধু থাকলে তো পেট চলবে না। বম্বেতে থাকার খরচের জন্যও উপার্জন দরকার। ফিল্মে কাজ পাওয়ার আগে তাই ছোটখাটো চাকরি করতে শুরু করেন দেব আনন্দ। প্রথমে মিলিটারি পোস্টাল সার্ভিসে মাসে ৪৫ টাকা বেতনের চাকরি পান। পরে দাদা চেতনের সঙ্গে একটি থিয়েটারের দলেও নাম লেখান।
থিয়েটার করতে গিয়েই দেখা বাবু রাও পাইয়ের সঙ্গে। দেব তাঁর কাছে ফিল্মে কাজের সুযোগ চেয়েছিলেন। শোনা যায় দেব আনন্দের অভিনয়ের থেকেও বেশি তাঁর হাসি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন বাবু রাও। তিনি বলেছিলেন, ওই হাসি দেখতেই দর্শক হলে আসবে। মাসে ৪০০ টাকার চুক্তিতে তাঁকে তিন বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ করেন বাবু রাও। প্রথম ছবির কাজও শুরু করেন— ‘হাম এক হ্যায়’।
ভারতীয় সিনেমায় রোম্যান্টিক নায়কের ক্ষেত্রে দেব আনন্দ নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। অগণিত নারীহৃদয়ে তিনি দোলা দিয়েছেন। শোনা গিয়েছে সহঅভিনেত্রীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের গুঞ্জনও। কিন্তু দেব আনন্দের মনে প্রথম যিনি দাগ কেটেছিলেন, তিনি সুরাইয়া। বলিউডের প্রেম পর্বের অন্যতম ছিল দেব আনন্দ-সুরাইয়া সম্পর্ক। যদিও সম্পর্কের পরিণতি ছিল বিয়োগান্তক।
প্রথম দেখা হয়েছিল চল্লিশের দশকের শেষ দিকে। তখন দেব আনন্দ সবে পা রেখেছেন ইন্ডাস্ট্রিতে। চেষ্টা করছেন পরিচিতি পাওয়ার। অন্যদিকে সুরাইয়া তখন খ্যাতির মধ্যগগনে। নায়িকা ও গায়িকা হিসেবে তিনি তখন প্রথম সারিতে।
নায়িকা সুরাইয়ার রূপ ও গুণে প্রথম আলাপেই মুগ্ধ হন দেব আনন্দ। সবথেকে ভাল লেগেছিল নায়িকার ‘ডাউন টু আর্থ’ মনোভাব। ভাললাগার মানুষের সঙ্গেই এল অভিনয়ের সুযোগ। ১৯৪৮ সালে মুক্তি পায় দেব আনন্দ-সুরাইয়ার ছবি ‘বিদ্যা’। ছবিতে ‘কিনারে কিনারে চলে যায়েঙ্গ’ গানের শুটিংয়ের সময় নৌকো উল্টে প্রায় ডুবে যাচ্ছিলেন সুরাইয়া। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তাঁকে বাঁচান দেব আনন্দ। এই ঘটনার পর থেকে দেব আনন্দের প্রেমে সুরাইয়া হাবুডুবু খেতে লাগলেন।
পরে এক স্মৃতিকথায় সুরাইয়া বলেন, দেব আনন্দের ব্যক্তিত্বের সাদাসিধে দিকটাই তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। প্রাণরক্ষার পরে সুরাইয়া বলেছিলেন, ‘তুমি যদি না বাঁচাতে, আজ আমার জীবন শেষ হয়ে যেত।’ শুনে নাকি দেব আনন্দ বলেছিলেন, ‘তোমার জীবন শেষ হলে সেইসঙ্গে আমারটাও শেষ হয়ে যেত।’ এরপর দু’জনের সম্পর্ক গাঢ় হতে আর দেরি হয়নি।
দু’বছর তাঁদের সম্পর্ক গোপন রেখেছিলেন দেব আনন্দ-সুরাইয়া। জানতেন শুধু ইন্ডাস্ট্রির ঘনিষ্ঠজন। ১৯৫০ সালে ‘আফসর’ সিনেমার শুটিংয়ের সময় তাঁদের প্রণয় প্রকাশ্যে আসে। তার আগে একবার পালানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন দু’জনে। ১৯৪৯ সালে ‘জিৎ’ ছবির শুটিংয়ের সময় পালিয়ে গিয়ে বিয়ের করবেন বলে ঠিক করেছিলেন দেব আনন্দ-সুরাইয়া। তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সহঅভিনেত্রী দুর্গা খোটে। কিন্তু এক সহ পরিচালক এই খবর জানিয়ে দেন সুরাইয়ার বাড়িতে। তাঁর দিদিমা এসে সেট থেকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছিলেন সুরাইয়াকে।
সুরাইয়ার পরিবারে তাঁর দিদিমা বাদশা বেগম ও মামার মারাত্মক প্রভাব ছিল। কার্যত দোর্দণ্ডপ্রতাপ দিদিমা-ই ছিলেন সংসারের শেষ কথা। তিনি কোনওমতেই নাতনির সঙ্গে দেব আনন্দের সম্পর্ক মেনে নিতে পারেননি। কারণ, সংসারের মূল উপার্জনক্ষম সুরাইয়ার বিয়ে দিতে তাঁরা রাজি ছিলেন না। পাশাপাশি, রক্ষণশীল বাদশা বেগম মেনে নিতে পারেননি, এক জন ভিন্নধর্মী তাঁদের পরিবারের জামাই হবে।
১৯৫০ সালে মুক্তি পায় তাঁদের ছবি ‘নীলি’। শুটিং সেটে সুরাইয়াকে আরও একবার বিয়ের প্রস্তাব দেন দেব আনন্দ। পালিয়ে গিয়ে বিয়েতেও কোনও আপত্তি ছিল না তাঁর। কিন্তু সামাজিক চক্ষুলজ্জার ভয়ে রাজি হননি সুরাইয়া। রাগে জ্ঞান হারিয়ে প্রেমিকাকে চড় মেরেছিলেন দেব আনন্দ। বলেছিলেন, ‘সুরাইয়া ভীতু ও কাপুরুষ।’ পরে এই ঘটনার জন্য বার বার ক্ষমা চান অনুতপ্ত দেব আনন্দ। পরের বছর সুরাইয়াকে হিরের আংটি দিয়ে প্রোপোজ করেন দেব আনন্দ। সেটি অনামিকায় পরেও ফেলেন সুরাইয়া। তবে সেই আংটি তাঁর দিদিমার নজর এড়ায়নি। এমনকি, তিনি যখন জানতে চান, সুরাইয়া সত্যি কথা-ই বলেন। ওই আংটি তাঁর হাত থেকে খুলে নিয়ে সমুদ্রে ছুড়ে ফেলে দেন বাদশা বেগম।
এর পর দেব আনন্দ-সুরাইয়া দেখা সাক্ষাৎও বন্ধ করে দেন বাদশা বেগম। কামিনী কৌশলের মতো বন্ধুর হাত দিয়ে তাঁরা একে অন্যকে চিঠি পাঠাতেন। দেব আনন্দের ফোন এলেও সুরাইয়াকে ধরতে দেওয়া হত না। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল একসঙ্গে অভিনয়ও। ১৯৫১ সালে মুক্তি পেয়েছিল দেব আনন্দ-সুরাইয়া জুটির শেষ ছবি ‘সনম’।
তাঁদের এই সম্পর্কে সায় ছিল সুরাইয়ার বাবা মায়ের। কিন্তু দিদিমা বাদশা বেগমের বিরুদ্ধাচারণ তাঁরা করতে পারেননি। দেব আনন্দ-ও বলেছিলেন তিনি, ভালবাসা ছাড়া কোনও ধর্মকে মানেন না। কিন্তু সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারেননি সুরাইয়া নিজেই। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে নিজেই জানিয়েছিলেন অপারগতার কথা। অভিযোগ, দেব আনন্দকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন সুরাইয়ারা দিদিমা ও মামা। এরপর সুরাইয়া নিজেকে এই সম্পর্ক থেকে সরিয়ে নেবেন বলে স্থির করেন। তিনি চাননি, তাঁর জন্য দেব আনন্দের কোনও ক্ষতি হোক।
তবু দেব আনন্দ আসতেন তাঁর প্রেয়সীর সঙ্গে দেখা করতে। বাড়ির পিছনের সিঁড়ি দিয়ে উঠে সুরাইয়ার সঙ্গে দেখা করতেন বাড়ির ছাদে। সেখানেই তাঁদের শেষ দেখা হয়েছিল। বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন সুরাইয়ার মা। সেটাই ছিল দু’জনের শেষ সাক্ষাৎ। দু’জনেই ঠিক করেছিলেন আর দেখা করবেন না। শেষ হয়ে গিয়েছিলে দু’জনের চার বছরের সম্পর্ক। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়া দেব আনন্দের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর দাদা চেতন আনন্দ। পরামর্শ দিয়েছিলেন সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসে অভিনয়ে মনোনিবেশ করতে।
দেব আনন্দ বিয়ে করেছিলেন ১৯৫৪-এ। অভিনেত্রী তথা তাঁদের প্রোডাকশন হাউজ ‘নবকেতন ফিল্মস’-এর কর্মী মোনা সিংহ ওরফে কল্পনা কার্তিকের সঙ্গে সাত পাকে বাঁধা পড়েন তিনি। জীবনে যত বার সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, বেশির ভাগ সময়েই মুখোমুখি হয়েছেন সুরাইয়া-প্রসঙ্গের। কোনও বারই প্রশ্ন এড়িয়ে যাননি। উজাড় করে দিয়েছেন নিজের স্মৃতি।
দেব আনন্দের কেরিয়ারের উত্থান ৫০-এর দশকের শেষ দিকে। দাদা চেতনের সঙ্গে নিজের প্রযোজনা সংস্থা ‘নবকেতন ফিল্মস’ খোলেন দেব আনন্দ। একের পর এক হিট ছবিও দিতে থাকেন। ১৯৭০-এ দেব আনন্দের বয়স যখন প্রায় ৫০ তখনও তার ছবি ‘জনি মেরা নাম’ সুপারহিট। তার আগের কয়েক বছরে ‘জুয়েল থিফ’, ‘গাইড’-এর মতো ছবিও হিট করেছে। পরের বছর ১৯৭১-এ সুপারহিট হয় ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ ছবিটি।
৮০-র দশকে দেব আনন্দের বয়স যখন ৬০ ছুঁইছুঁই তখনও বহু ছবিতে নায়কের চরিত্র পেয়েছেন। অথচ তাঁর সমসাময়িক দিলীপ কুমার তত দিনে ছবি করা কমিয়ে দিয়েছেন। কিছুটা সিনিয়র রাজ কপূরও বন্ধ করেছেন ছবির কাজ। ছবির সংখ্যার নিরিখেও এঁদের থেকে অনেক এগিয়ে দেব আনন্দ। ১১৫টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। যেখানে দিলীপ অভিনয় করেছেন ৪৮টি ছবিতে। রাজ ৩০টিতে।
চিরসবুজ দেব আনন্দ প্রয়াত হন ৮৮ বছর বয়সে। ২০১১-র ৩ ডিসেম্বর। তাঁকে বলা হয় ভারতীয় সিনেমার ‘গ্রেগরি পেক’। শোনা যায়, প্রেয়সী সুরাইয়ার মন জয় করতেই তিনি গ্রেগরি পেক-কে অনুসরণ করতেন। কারণ গ্রেগরি পেক ছিলেন সুরাইয়ার প্রিয় অভিনেতা।