যাবতীয় প্রতিকূলতা, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতাকে সরিয়েই আরও পাঁচ বছরের জন্য মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতায় আসতে চলেছে বিজেপি। প্রাথমিক গণনার পর এটা স্পষ্ট যে, ভোপালের কুর্সিতে বসা হচ্ছে না কংগ্রেসের।
অথচ কংগ্রেসের কাছে এই নির্বাচন ছিল ‘শোধ তোলার ভোট’। ২০১৮ সালে মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতায় এসেছিল কংগ্রেস। প্রায় দেড় দশক ক্ষমতায় থাকার পর প্রথম বার পরাজয়ের মুখ দেখেছিল বিজেপি।
তবে কংগ্রেসের রাজনৈতিক মধুমাস খুব বেশি দিনের জন্য স্থায়ী হয়নি মধ্যপ্রদেশে। কারণ ২০২২ সালের মার্চে অনুগত ২২ জন বিধায়ককে নিয়ে দল ছেড়েছিলেন তৎকালীন কংগ্রেস নেতা অধুনা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জ্যোতিরাদিত্য শিন্ডে।
শিন্ডের দলত্যাগে মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতা হারিয়েছিল কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রী পদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা কমল নাথ। সেই সময় কংগ্রেসের তরফে অভিযোগ তোলা হয়েছিল যে, ভোটদাতাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বিজেপি।
গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকারকে ‘অগণতান্ত্রিক’ ভাবে ফেলে দেওয়ার অভিযোগে বিজেপির বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছিল কংগ্রেস। এই নির্বাচনকে তাই ‘জবাব’ দেওয়ার নির্বাচন হিসাবে বেছে নিয়েছিল হাত শিবির।
কংগ্রেসকে পুনরায় ক্ষমতায় ফেরানোর দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি কমল নাথ। গণনার প্রাথমিক ফলাফল বলছে, দলকে জেতানো দূরস্থান, নিজের ছিন্দওয়াড়া আসনই তিনি ধরে রাখতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
কংগ্রেসকে ক্ষমতায় ফেরাতে পুরনো সমীকরণ ভুলে কাছাকাছি এসেছিলেন মধ্যপ্রদেশের দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, কংগ্রেসের কমল নাথ এবং ‘রাঘোগড়ের রাজা’ বলে পরিচিত দিগ্বিজয় সিংহ।
বলিউডি ব্লকব্লাস্টার ‘শোলে’র দুই চরিত্রের অনুষঙ্গে কমল-দিগ্বিজয়ের জুটিতে জয়-বীরু জুটি বলে বর্ণনা করছিলেন কংগ্রেস নেতারা। কিন্তু ভোট-ফলাফল বলছে দলকে কাঙ্ক্ষিত জয় এনে দিতে ব্যর্থ এই দুই প্রবীণ নেতা।
বিজেপির অনেকেই আবার মনে করছেন, তাদের এই জয়ের নেপথ্যে রয়েছেন দলের বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান, যিনি আবার রাজ্য রাজনীতিতে ‘মামা’ নামে পরিচিত।
এক সময় মধ্যপ্রদেশের এই ‘মামা’ই বিজেপিতে কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিলেন বলে দলের অন্দরে জল্পনা শুরু হয়ে যায়। শোনা যায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএসের সুনজরে না থাকার জন্য মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শিবরাজকে আর চাইছেন না বিজেপি নেতৃত্ব।
বিজেপির তরফে মধ্যপ্রদেশের ভোট ময়দানে নামানো হয় দলের সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নরেন্দ্র সিংহ তোমরকে। কিন্তু ভোটের কিছু দিন আগে তোমরের ছেলের একটি বিতর্কিত ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়।
তার পরই কার্যত অন্তরালে চলে যান তোমর। ক্রমশ শিবরাজের উপরেই আস্থা রাখার ইঙ্গিত দেন বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব। তাঁর উপর আস্থা রাখার মর্যাদা যে শিবরাজ দিচ্ছেন, তা মধ্যপ্রদেশের ফলাফলে স্পষ্ট।
মূলত শিবরাজের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা, একাধিক সামাজিক প্রকল্পে ভর করেই বিজেপি মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতা ধরে রাখতে চলেছে বলে মনে করছেন অনেকে। কংগ্রেস ভোটপ্রচারে গিয়ে বলেছিল, তারা ক্ষমতায় এলে রাজ্যে জাতসমীক্ষা করবে।
বিজেপির সঙ্গে টেক্কা দিতে একাধিক সামাজিক প্রকল্প চালুরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কংগ্রেস। তবে ভোট-ফলাফলেই ইঙ্গিত, বিজেপির উপরে এখনই আস্থা হারাতে নারাজ ভোটদাতাদের বড় একটি অংশ।
বুথফেরত সমীক্ষাতেই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল যে, মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতায় থাকছে বিজেপিই। তবে কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের আসনের ব্যবধান যে এতটা হবে, সে ইঙ্গিত ছিল না ওই সমীক্ষাগুলোয়। শেষ পর্যন্ত এই ফলাফল বজায় থাকলে মাঝের দু’বছর বাদে টানা ২০ বছর মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতায় থাকতে চলেছে বিজেপি।
রবিবার ভোটগণনার দিনে ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার কথা স্মরণ করে শিবরাজ বলেন, “আজও ১৯৮৪ সালের ২ আর ৩ ডিসেম্বরের ঘটনা মনে পড়লে আমরা কেঁপে উঠি। গ্যাস দুর্ঘটনায় হাজার হাজার ভাইবোনকে হারিয়েছি। প্রাণ বাঁচাতে রাস্তায় পাগলের মতো ছুটছিলেন মানুষ। দৌড়তে দৌড়তে পড়ে যাচ্ছিলেন। ভোপালের ওই ভয়ানক দৃশ্য ভোলার নয়। সকলকে আমার প্রণাম, শ্রদ্ধা জানাই।”
শিবরাজের এই মন্তব্যে জল্পনা এই যে, রাজ্যের বিদায়ী এবং ভাবী মুখ্যমন্ত্রী হিসাবেই এই মন্তব্য করেছেন তিনি। অন্য দিকে আপাদমস্তক রাজনীতিক মন্তব্য করে কমল নাথ শনিবার সকালে বলেন, “মধ্যপ্রদেশের মানুষের উপর আমার বিশ্বাস আছে।” অর্থাৎ মধ্যপ্রদেশবাসী শেষমেশ কংগ্রেসকেই বেছে নেবে বলে বিশ্বাস রেখেছিলেন কমল নাথ। খুব সম্ভবত, এ বারের মতো তাঁর বিশ্বাসের মর্যাদা দিলেন না ভোটদাতারা।