মমির দেশ মিশরে কত না রহস্যের ঘনঘটা। বিভিন্ন সমাধিস্থল ঘুরলেই না জানা কত প্রশ্ন ঘুরপাক খায় মনের কিনারায়। যে প্রশ্নের সদুত্তর এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি কুমিরের কয়েকটি মমিকৃত দেহ উদ্ধার ঘিরে নতুন রহস্য দানা বেঁধেছে।
মিশরের একটি সমাধিস্থলে কুমিরের একাধিক মমিকৃত অংশাবশেষ পাওয়া গিয়েছে। কুমিরগুলির মাথা কাটা রয়েছে। পড়ে রয়েছে শুধুমাত্র দেহাংশ। কুমিরগুলির মৃত্যু কী ভাবে হল, এ নিয়ে ধন্দে গবেষকরা।
নীল নদের পশ্চিম তীরে ‘কুব্বাত-আল-হাওয়া’ এলাকায় কুমিরের দেহগুলির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। গবেষকদের মতে, কুমিরের দেহাংশগুলি সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছিল। কুমিরগুলিকে হত্যার পর রোদে পুড়ে তাদের দেহ শুকিয়ে যায়, তার পর তাদের মাথা কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে।
তবে মিশরে কুমিরের মমিকৃত দেহ উদ্ধারের নেপথ্যে নানা পৌরাণিক কাহিনির তত্ত্বও উঠে এসেছে। এক সময় দেবতাদের পুজোয় নৈবেদ্য হিসাবে পশুর মমি দেওয়া হত। এই কুমিরগুলিকে মেরে তাদের দেহ সংরক্ষণ করার নেপথ্যে এই কারণ থাকতে পারে বলে মনে করছেন ‘দ্য রয়্যাল বেলজিয়ান ইনস্টিটিউটের’ গবেষক বি দ্য কোপারে।
মমিকৃত কুমিরের দেহাবশেষ নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন কোপারে। দেবতাকে নৈবেদ্য হিসাবে পশুর মমি দেওয়ার চলের কথা যেমন তিনি তুলে ধরেছেন, তেমনই আবার জানিয়েছেন, কুমিরকে দেবতাদের অবতার বলে সে কালে মনে করতেন মিশরীয়রা।
কিন্তু কুমির যদি দেবতারই কোনও অবতার হয়, তা হলে তাকে হত্যা করা হবে কেন? ওই গবেষকের কথায়, কোনও প্রাণীর মমির সঙ্গে আধ্যাত্মিক যোগসূত্র যদি খুঁজে পাওয়া যায়, তা হলে সেই প্রাণীহত্যা কোনও পাপ হিসাবে মনে করতেন না মিশরীয়রা।
গবেষকরা এ-ও মনে করছেন যে, দেবতাকে তুষ্ট করার জন্যই কুমির হত্যা করা হত। এই প্রসঙ্গে মিশরের দেবতা সোবেকের নাম চর্চায় এসেছে। মিশরীয় সভ্যতায় সোবেক এমন এক দেবতা, যাঁর মুখাবয়ব কুমিরের মতো । আর দেহের বাকি অংশটি মানুষের মতো।
ফলে গবেষকরা অনেকেই মনে করছেন, মিশরীয় দেবতা সোবেককে তুষ্ট করতেই কুমির মারা হত। আর সে কারণেই হয়তো কুমিরকে মারার পর তাদের দেহগুলি সংরক্ষিত করে রাখা হত। তার পর পশুর মমি হিসাবে সেগুলি নৈবেদ্য দেওয়া হত।
তবে সম্প্রতি খননকার্যের পর কুমিরগুলিকে যে অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে, তা এক কথায় বিরল। কুমিরের মুণ্ডহীন দেহাবশেষ উদ্ধারের ঘটনা বিরল বলেই মনে করছেন গবেষকরা।
কুমিরগুলিকে হত্যার পর বালির সঙ্গে এমন ভাবে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যাতে সেগুলি রোদে প্রাকৃতিক ভাবে শুকিয়ে যায়। এর পর দেহগুলি খেজুর পাতা দিয়ে মুড়ে সমাধিস্থলে আনা হত। আর এ ভাবেই সংরক্ষিত করা হত বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
তবে সব কুমিরের দেহাংশই যে এ ভাবে সংরক্ষিত করা যেত, তা নয়। বহু ক্ষেত্রেই অনেক কুমিরের মমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কুমিরগুলির দেহাংশ শুকোনোর পরই তাদের মাথা কেটে বাদ দেওয়া হয়েছিল বলে মনে করছেন গবেষকরা।
কুমিরগুলিকে কী ভাবে মারা হল, সে ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত নন গবেষকরা। মৃত্যুর কারণও অনুধাবন করতে পারেননি তাঁরা।
তবে একাধিক উপায়ে কুমিরগুলিতে হত্যা করা হতে পারে বলে অনুমান করছেন গবেষকরা। প্রখর রোদের তাপে দীর্ঘ ক্ষণ কুমিরগুলিকে রাখা হয়েছিল, তার জেরে মৃত্যু হতে পারে বলে অনুমান। আবার অনেকের মতে, শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে কুমিরগুলিকে।
মিশরের যে প্রাচীন সমাধিস্থল থেকে কুমিরগুলির দেহাংশ উদ্ধার করা হয়েছে, সেটিকে ‘ডোম অফ দ্য উইন্ড’ বলা হয়। প্রায় ২৫০০ বছর আগে ওই সমাধিস্থল ব্যবহার করা হত বলে ধারণা।
মিশরে মমি ঘিরে নানা রহস্যের কাহিনি রয়েছে। কুমিরগুলির মুণ্ডহীন দেহাংশ উদ্ধার এই রহস্যের তালিকায় নতুন সংযোজন। কী কারণে কুমিরগুলির মৃত্যু, এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কিন্তু আসল কারণ কী? সেই রহস্যের কিনারা করতেই মুখিয়ে রয়েছেন গবেষকরা।