তিনি ছিলেন আমেরিকা প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের বড়কর্তা। অথচ তিনি কখনও চাননি তাঁর দেশ অন্য দেশে পরমাণু হামলা চালাক। তিনি চাইতেন, ভিয়েতনামের যুদ্ধ শেষ করে সঠিক নীতি প্রণয়ন করুক দেশ। ফিরে আসুক দেশের সৈনিকরা। এই সব কারণে দেশের প্রেসিডেন্টের রোষানলেও পড়তে হয়েছিল তাঁকে। এমনই মানবিক অথচ বিতর্কিত চরিত্র ছিলেন ড্যানিয়েল এলসবার্গ। যাঁর লেখা একটি বই ঝড় তুলেছিল আমেরিকায়।
ড্যানিয়েল ছিলেন এক জন আমেরিকান। যিনি আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সদর দফতর পেন্টাগনে চাকরি করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাঁর দেশ জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে যে পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল, তার ভয়াবহতা দেখেছিলেন তিনি। তাই আমেরিকা আবার পরমাণু যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক, চাননি ড্যানিয়েল।
পেন্টাগনে উচ্চপদে চাকরি করার সুবাদে দেশের গুরুত্বপূর্ণ বহু ফাইল দেখা ও পড়ার সুযোগ ছিল ড্যানিয়েলের কাছে। তিনি গোপন নথি প্রকাশ্যে এনে ভিয়েতনামে আমেরিকার ভূমিকা প্রকাশ্যে এনেছিলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধে নিয়ে আমেরিকার ভূমিকার কথা দেশের মানুষ জানুক, চেয়েছিলেন ড্যানিয়েল। তাই ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে যাবতীয় নথি তৈরি করে তা প্রকাশ্যে এনে দেশের সরকারের বিরোধিতা করেছিলেন তিনি।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার ভূমিকার সমালোচক ছিলেন তিনি। তাঁর দাবি ছিল, সরকার বার বার যুদ্ধ জয়ের দাবি করলেও বাস্তব পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। যুদ্ধে জয়ের কোনও সম্ভাবনা তো ছিলই না, বরং দেশের সেনা মারা যাচ্ছিলেন নির্বিচারে। তাই সত্য প্রকাশ্যে এনে নিজের ভূমিকার জন্য কখনও অনুতপ্ত হননি তিনি।
যুদ্ধ সংক্রান্ত যাবতীয় গোপন তথ্য ১৯৭১ সালে ফাঁস করে দেন তিনি। হইচই পড়ে যায় দেশ জুড়ে। সরকারের যুদ্ধনীতির বিরুদ্ধে পথে নামতে শুরু করে জনতা। ‘পেন্টাগন পেপার লিক’-এর চাপে ১৯৭৩ সালে ভিয়েতনামের যুদ্ধ ছেড়ে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় আমেরিকা।
‘পেন্টাগন পেপার লিক’-এর ঘটনায় আমেরিকার আইন অনুযায়ী ড্যানিয়েলের ১২৫ বছরের কারাদণ্ড হতে পারত। কারণ সরকার মনে করেছিল এ ভাবে গোপন সরকারি নথি ফাঁস করা দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু সেই সময় আমেরিকা সরকারের আরও একটি কেলেঙ্কারি সামনে এসে পড়ায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি।
‘পেন্টাগন পেপার’ ফাঁস হওয়ার সময় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন রিচার্ড নিক্সন। তিনি আবার ভিয়েতনাম যুদ্ধের পক্ষে ছিলেন। গোপন নথি প্রকাশ্যে আসায় তাঁকে সেনাবাহিনীকে ফেরত আনার নির্দেশ দিতে হয়। এর ফলে ড্যানিয়েলের ওপর বেজায় খাপ্পা ছিলেন নিক্সন।
ড্যানিয়েলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হোয়াইট হাউস একটি বিশেষ দল গঠন করেন। সেই দলকে প্রেসিডেন্ট নির্দেশ দেন যে, ড্যানিয়েল যে মানসিক ভাবে সুস্থ নন এবং তিনি যে মনোবিদের কাছে যান, তা প্রমাণ করতে ফোন ট্যাপ করতে হবে। জানতে হবে ড্যানিয়েলের জীবনের গোপন কথা।
প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নির্দেশ মতো ড্যানিয়েলের চিকিৎসকের ফোনও ট্যাপ করা হয়। নিক্সনের নির্দেশে তাঁর বিরোধীদের ফোনও ট্যাপ করা হত। সেই সব ফোন ট্যাপিংয়ের কথা জানাজানি হতেই আমেরিকার সংবাদমাধ্যমে শোরগোল পড়ে যায়। আমেরিকার ইতিহাসে এই ফোন ট্যাপিংয়ের ঘটনাকে ‘ওয়াটার গেট’ কেলেঙ্কারি আখ্যা দেওয়া হয়। কেলেঙ্কারির চাপে শেষ পর্যন্ত আমেরিকান প্রেসিডেন্টের পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন নিক্সন।
এর পর আমেরিকার আদালতও ড্যানিয়েলকে যাবতীয় অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি দেয়। ড্যানিয়েল চেয়েছিলেন আমেরিকা আর যেন পরমাণু যুদ্ধে না জড়িয়ে পড়ে। তাই ভিয়েতনাম সংক্রান্ত যাবতীয় নথি, পরমাণু অস্ত্র ও তার ব্যবহার সংক্রান্ত বহু নথি প্রতিলিপি আকারে নিজের জিম্মায় রেখেছিলেন।
ড্যানিয়েল চেয়েছিলেন, আগে ভিয়েতনামের যুদ্ধে শেষ হোক। তার পর একে একে পরমাণু বোমা ও তার ব্যবহার নিয়ে আমেরিকার সরকারের পরিকল্পনা প্রকাশ্যে আনবেন। কিন্তু পেন্টাগন পেপার ফাঁস হওয়ার পর তার ওপর সরকারের নজরদারি, মামলা ও ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারির কারণে পরিকল্পনা স্থগিত করেন।
আমেরিকান প্রশাসন তাঁর বাড়িতে হানা দিতে পারে, এই আশঙ্কায় সব গুরুত্বপূর্ণ নথি নিজের ভাই হ্যারিকে রাখতে দেন ড্যানিয়েল। সঙ্গে বলে দেন, সব কাগজপত্র যেন কোনও গোপন জায়গায় রাখা হয়। কিন্তু সেই নথিতে কী রয়েছে, গোপনীয়তার কারণে ভাইকে বলেননি তিনি।
দাদার থেকে কাগজপত্র পেয়ে একটি বাক্সে রেখে তা নিজের বাগানে পুঁতে দেন হ্যারি। একের পর এক ঘটনায় দাদার জড়িয়ে পড়ার ঘটনায় শঙ্কিত হ্যারি নিজের বাগান থেকে বাক্সটি তুলে শহরের একটি প্রান্তে গিয়ে পুঁতে দেন। ঘটনাচক্রে সেই জায়গাটি ছিল শহরের নোংরা ও আবর্জনা ফেলার জায়গা। আর যে দিন হ্যারি বাক্সটি ওই আবর্জনা ফেলার জায়গায় পুঁতে আসেন, সে দিনই তাঁর বাড়িতে হানা দেয় এফবিআই।
আবর্জনা ও নোংরা ফেলার জায়গা যেখানে বাক্সটি পোঁতা হয়েছিল, তা চেনার জন্য একটি স্টোভ রেখে এসেছিলেন হ্যারি। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে প্রবল ঝড়ের কারণে ওই স্টোভটি উড়ে যায়। তাই কোথায় সেই সব জরুরি নথি পোঁতা হয়েছিল, তা চিহ্নিত করা মুশকিল হয়ে পড়ে।
এক বান্ধবী ও তাঁর স্বামীকে নিয়ে হ্যারি বাক্স পোঁতার জায়গাটি খুঁজতে যান। কিন্তু হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হয় তাঁদের। টানা এক বছর চেষ্টা করেও আর সেই নথি বা বাক্সের হদিস পাননি হ্যারি। শেষে স্থানীয় পুরসভা ওই এলাকার যাবতীয় আবর্জনা তুলে একটি গর্তে ফেলে তাতে কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে দেয়।
ভাইয়ের কাছ থেকে নথি হারানোর কথা জানতে পেরে ভেঙে পড়েন ড্যানিয়েল। কিন্তু সেই সময় তাঁর আর কিছুই করার ছিল না। পরে নিজের জীবনের ঘটনাক্রম নিয়ে একটি বই লেখেন তিনি। নাম দেন, ‘দি ডুমস মেশিন’।
সেই বইতে তিনি দাবি করেছিলেন, যে সব নথি তাঁর হাতে এসেছিল তাতে পরমাণু যুদ্ধে ৫০ কোটি মানুষের মৃত্যুর কথা উল্লেখ ছিল। পরে সেই সরকারি নথি প্রকাশ্যে আসায় জানা যায়, বইতে লেখা ডানিয়েলের কথা সত্যি ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরমাণু বোমা নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল গোটা বিশ্বে। ৬০-এর দশকে শীতল যুদ্ধে দুই শক্তিধর রাষ্ট্র আমেরিকা ও সোভিয়েতের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ ছিল চরমে। এমন আবহে আমেরিকার প্রতিবেশী রাষ্ট্র কিউবায় পরমাণু অস্ত্র সাজিয়ে তা আমেরিকার দিকে তাক করে রেখেছিল রাশিয়া।
বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রপ্রধান জানতেন, এখন পরমাণু যুদ্ধ কেবলমাত্র সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু তাঁর দেশ সেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক চাননি ড্যানিয়েল এলসবার্গ। তাই দেশের গোপন নথি নিজের জিম্মায় এনে পৃথিবীকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন আরও এক পরমাণু যুদ্ধ থেকে।