গ্রেফতার হওয়া কোনও দাগি আসামিকে বিচার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই পুলিশ হেফাজতে হত্যা বা এনকাউন্টার নিয়ে নানা বিতর্ক দানা বেঁধেছে বার বার। অনেকেই বলেন, এনকাউন্টার নাগরিক অধিকারের পরিপন্থী।
তবে বন্দি আসামি পুলিশের হাত থেকে পালানোর চেষ্টা করলে বা পুলিশকে পাল্টা আক্রমণের আয়োজন করলে, এনকাউন্টারের অনুমতি রয়েছে। আকছার তেমন এনকাউন্টারের কথা শোনা যায়। যার সাম্প্রতিকতম সংযোজন, ‘গ্যাংস্টার’ আতিক আহমেদের পুত্র আসাদের মৃত্যু।
দুঁদে পুলিশকর্তাদের নামের সঙ্গে একাধিক এনকাউন্টারের নজির মিশে থাকে প্রায়শই। বলিউড কিংবা টলিউডের পর্দায় এই ধরনের অফিসারদের কীর্তি তুলে ধরা হয়েছে বার বার। সিনেমার স্বর কখনও এনকাউন্টারের পক্ষে, কখনও বিপক্ষে কথা বলেছে।
তেমনই এক পুলিশ অফিসার দহয়াজী গোবরজী বনজ়ারা। ১৯৮০ সালে গুজরাত পুলিশে ডেপুটি সুপারিনটেন্ডেন্ট হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। তার পর ধীরে ধীরে পদোন্নতি, পদচ্যুতি, কারাবাসের ইতিহাস পেরিয়ে গুজরাতের অন্যতম চর্চিত ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন।
২০১৪ সালের ৩১ মে পুলিশের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর দীর্ঘ দিনের কেরিয়ার ছিল বিতর্কে জর্জরিত। গুজরাত পুলিশের ‘এনকাউন্টার বিশেষজ্ঞ’ হয়ে উঠেছিলেন বনজ়ারা।
২০০৭ সালে বনজ়ারা যখন গুজরাত পুলিশের সন্ত্রাসদমন শাখার প্রধান ছিলেন, ভুয়ো এনকাউন্টার মামলায় তিনি দোষী সাব্যস্ত হন। ২০১৫ সাল পর্যন্ত জেল খাটেন এই পুলিশকর্তা। তার পর মুক্তি পান জামিনে।
২০১৭ সালে ওই ভুয়ো এনকাউন্টার মামলায় ক্লিনচিট পান বনজ়ারা। অবসরের ৬ বছর পর তাঁর পদোন্নতিও হয়। ২০২০ সালে আইজি পদে উন্নীত হন তিনি। ২০০৭ সালের হিসাবেই সেই পদোন্নতি কার্যকর করা হয়েছিল।
বনজ়ারার নামের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে সোহরাবুদ্দিন শেখ হত্যা মামলার কথা। সোহরাবুদ্দিন ছিলেন তৎকালীন এক কুখ্যাত দুষ্কৃতী। খুন-জখম থেকে শুরু করে জঙ্গিযোগ, বহু অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে ছিল।
২০০৫ সালের ২৬ নভেম্বর গুজরাতে গুলি করে খুন করা হয় সোহরাবুদ্দিনকে। পুলিশের গুলিতেই তাঁর মৃত্যু হয়। গুজরাত পুলিশ দাবি করে, সোহরাবুদ্দিন বন্দি অবস্থায় পালানোর চেষ্টা এবং পুলিশকে প্রত্যাঘাতের চেষ্টা করায় তাঁকে এনকাউন্টারে মারা হয়েছে।
সোহরাবুদ্দিন একা নন, তাঁর স্ত্রী কৌসর এবং সঙ্গী তুলসিরাম প্রজাপতিও পুলিশের গুলিতে নিহত হন বলে অভিযোগ। এই তিন হত্যা মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পরিচালিত তৎকালীন গুজরাত সরকারকে টলিয়ে দিয়েছিল।
সিবিআইয়ের চার্জশিট অনুযায়ী, ২০০৫ সালের ২৩ নভেম্বর স্ত্রী এবং তুলসিরামের সঙ্গে বাসে করে হায়দরাবাদ থেকে আমদাবাদ যাচ্ছিলেন সোহরাবুদ্দিন। অভিযোগ, রাত দেড়টা নাগাদ বনজ়ারার নেতৃত্বে গুজরাত পুলিশের সন্ত্রাসদমন শাখা মহারাষ্ট্রে বাসটি থামায়। তুলে নিয়ে যাওয়া হয় সোহরাবুদ্দিন এবং তুলসিরামকে। কৌসর বাধা দিলে তাঁকেও নিয়ে যায় পুলিশ।
তিন দিন পর, ২৬ তারিখ সোহরাবুদ্দিনকে গুলি করে মারা হয়। অভিযোগ, ‘এনকাউন্টার’ করেছিলেন বনজ়ারাই। সিবিআইয়ের চার্জশিটের সঙ্গে পুলিশের বিবৃতির মিল ছিল না। পুলিশ জানিয়েছিল, সন্দেহজনক অবস্থায় সোহরাবুদ্দিনকে মোটরবাইকে যেতে দেখা গিয়েছিল। থামতে বললেও তিনি থামেননি। উল্টে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালান। তাই এনকাউন্টার করতে হয়েছে।
সোহরাবুদ্দিনের দেহে ৮টি গুলি লেগেছিল। তাঁর মৃত্যুর পর বনজ়ারা সাংবাদিক বৈঠক করে জানান, সোহরাবুদ্দিন কুখ্যাত শার্পশুটার। লস্কর-ই-তইবা এবং আইএসআইয়ের ইশারায় তিনি গুজরাতে এক রাজনৈতিক নেতাকে হত্যা করতে এসেছিলেন।
সোহরাবুদ্দিনের মৃত্যুর দু’তিন দিনের মধ্যেই মেরে ফেলা হয় তাঁর স্ত্রী কৌসরকে। গুজরাতের এক গ্রামে কেউ বা কারা তাঁকে গুলি করে মেরে দেহ সৎকার করে ফেলেন। অভিযোগ, কৌসরকে হত্যার আগে ধর্ষণও করা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রেও অভিযোগের তির ছিল এক পুলিশ কনস্টেবলের দিকে।
এখানেই শেষ নয়, সোহরাবুদ্দিনের মৃত্যুর ঠিক এক বছর পর ২০০৬ সালের ২৬ নভেম্বর তাঁর সঙ্গী তুলসিরামকেও একই ভাবে গুলি করে খুন করা হয়। তুলসিরাম ছিলেন সোহরাবুদ্দিনের হত্যার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী।
সোহরাবুদ্দিনের অপরাধের ইতিহাস নিয়ে তিন রকমের মত প্রচলিত গুজরাতে। কেউ বলেন, তিনি স্বাধীন ভাবে চুক্তিভিত্তিক খুনের বায়না নিতেন। কেউ বলেন, খোদ দাউদের সঙ্গে ছিল তাঁর ওঠাবসা। অনেকে আবার বলেন, কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ আধিকারিকের হয়ে অপরাধমূলক কাজ করতেন সোহরাবুদ্দিন।
সোহরাবুদ্দিন হত্যা মামলার জল অনেক দূর গড়িয়েছিল। অমিত শাহের নামও এই হত্যার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। বলা হত, সে সময় বনজ়ারা নাকি ছিলেন শাহের ‘ডান হাত’। তুলসিরামের হত্যাকাণ্ডে শাহকেও জেলে যেতে হয়। শাহ তখন গুজরাতের মন্ত্রী ছিলেন। তাঁকে সেই পদ থেকেও ইস্তফা দিতে হয়েছিল।
বনজ়ারা অবশ্য শুধু সোহরাবুদ্দিন হত্যা মামলায় অভিযুক্ত নন। তাঁর বিরুদ্ধে আরও কিছু ভুয়ো এনকাউন্টারের অভিযোগ ছিল। ২০০২ সালে সমীর খান, ২০০৩ সালে সাদিক জামাল, ২০০৪ সালে ইশরৎ জাহান এবং তাঁর তিন সঙ্গীর মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়েছিল বনজ়ারার নাম।
নরেন্দ্র মোদীকে ‘ভগবান’ হিসাবে দেখতেন বনজ়ারা। প্রকাশ্যে বলেওছিলেন সে কথা। সোহরাবুদ্দিন হত্যা মামলায় উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের অভাবে তাঁকে ২০১৭ সালে ক্লিনচিট দেওয়া হয়।
সময় বদলেছে। অবসরের পর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন বনজ়ারা। যে বিজেপির সঙ্গে এক সময় ছিল তাঁর ‘ওঠাবসা’, ক্রমে সেই বিজেপির সঙ্গেও তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
২০২২ সালে গুজরাতে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন বনজ়ারা। তাঁর দলের নাম প্রজা বিজয় পক্ষ। হিন্দুত্বই ছিল এই দলের মূল কথা। ধর্মের ভিত্তিতে তাঁরা মানুষের জন্য কাজ করার শপথ নেন। গুজরাতে এই দল বিজেপির বিকল্প হতে পারে বলে দাবি করেছিলেন প্রাক্তন আইপিএস। বিজেপিকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলেও দাবি করেন তিনি।