একে বলা হয় ‘নরকের দ্বার’। তবুও প্রতি বছর প্রাণের তোয়াক্কা না করে লাখ লাখ মানুষ পাড়ি জমান এই পথেই। বিপদসঙ্কুল, বিস্তৃত, দুর্ভেদ্য ঘন অরণ্যের মাঝে জীবনের বাজি রেখে শুধুমাত্র উন্নত এক জীবনের প্রত্যাশায় এঁরা এগিয়ে চলেন প্রতি বছর।
কলম্বিয়া-পানামার মাঝের বিপজ্জনক বিস্তৃত জঙ্গল এই ডারিয়েন গ্যাপ। এতই ঘন ও দুর্ভেদ্য যে বহু চেষ্টা করেও এই ১০৬ কিমির জঙ্গল কেটে তৈরি করা সম্ভব হয়নি কোনও রাস্তা। আশপাশে নেই কোনও জনবসতিও।
উত্তর আমেরিকার আলাস্কা থেকে গাড়ি চালিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনা যেতে গেলে সেই যাত্রায় ছেদ টানতে হবে ডারিয়েন গ্যাপের কারণে। জঙ্গলের মধ্যে নেই যানবাহন চলার মতো কোনও রাস্তা, জলপথই একমাত্র উপায়।
তুরিয়া নদী ও তার সঙ্গে সংযুক্ত খালগুলিতে ছোট ছোট পিরাগুয়া বোট চলে। এই দুর্গম অঞ্চল পেরোতে সেগুলিই ভরসা।
বিষাক্ত সাপ, কাঁকড়াবিছে, আগুনে পিঁপড়ে, জাগুয়ার, বন্য শূকর এবং অন্য হিংস্র জীবজন্তু ছাড়াও এই এলাকায় রয়েছে মাদক পাচারকারী ও চোরাশিকারিদের দৌরাত্ম্যও।
দুর্ভেদ্য জঙ্গলের ভিতরে বিশেষ কোনও নজরদারি চালানো সম্ভব হয় না বলে অপরাধীদের মুক্তাঞ্চল বলা চলে ডারিয়েন গ্যাপকে।
এক বার কোনও মানুষ এদের হাতে ধরা পড়লে তাদের গুম করে পাচার করে দেওয়া হয় প্রায়শই। এমনকি ব্যবসার স্বার্থে মানুষ মারতেও হাত কাঁপে না এই সব দুর্ধর্ষ অপরাধীদের।
মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো রয়েছ তুরিয়া নদীর হড়পা বান, যা দু’-এক পশলা বৃষ্টি হলেই খরস্রোতে বনভূমি ভাসিয়ে নিয়ে যায় চোখের পলকে। ভরা বর্ষায় তো কথাই নেই ।
এত বিপদের হাতছানি সত্ত্বেও হাজারো অভিবাসন-প্রত্যাশীর জন্য ডারিয়েন গ্যাপ এলাকাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হয়ে উঠেছে।
কলম্বিয়া ও পানামার মধ্যে অবস্থিত এই দুর্গম জলাভূমি এবং পার্বত্য বনাঞ্চল পাড়ি দিয়ে অভিবাসী হওয়ার চেষ্টা চালানো মানুষদের মধ্যে শিশু-কিশোরের সংখ্যা আশঙ্কাজনক ভাবে বেড়েছে।
প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি বা অভিভাবকের সঙ্গ ছাড়াই অপ্রাপ্তবয়স্কেরা ডারিয়েন গ্যাপ পেরোনোর চেষ্টা করছে, এমন দৃশ্যও দেখা যাচ্ছে প্রায়শই।
ইউনিসেফের তথ্য বলছে, চার মাসে বিপজ্জনক ডারিয়েন গ্যাপ পাড়ি দিয়েছে ৩০ হাজার শিশু-কিশোর অভিবাসী। তাদের এই সংখ্যা ৩৪ শতাংশ বেড়ে ১ লাখ ৬০ হাজারে পৌঁছতে পারে বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ।
ইউনিসেফের এক শীর্ষ স্থানীয় আধিকারিক টেড চাইবান জানিয়েছেন, ডারিয়েন গ্যাপ শিশুদের চলাচলের জন্য উপযোগী নয়। এই কঠিন ও বিপজ্জনক পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনেক শিশু মারাও গিয়েছে। এমনকি নারীরা এ পথে চলতে চলতে সন্তান প্রসবও করেছেন।
ডাকাতি, অপহরণ এবং যৌন নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েও চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ১ লক্ষ ১৭ হাজার অভিবাসী দীর্ঘ বিরামহীন যাত্রা পায়ে হেঁটে অতিক্রম করেছে বলেছে পানামা সরকার জানিয়েছে।
একটু ভাল ভাবে বেঁচে থাকা। ব্যস, এইটুকুই প্রত্যাশা। মূলত ভেনেজুয়েলা, গায়ানা, কলম্বিয়া, ব্রাজিলের মতো দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলি থেকে উত্তর আমেরিকার অভিবাসী হওয়ার জন্য লাখ লাখ মানুষ এই পথে পানামা পৌঁছতে চায়।