নির্ধারিত সময়েই হাওড়ার শালিমার স্টেশন থেকে চেন্নাইয়ের উদ্দেশে রওনা দেয় আপ করমণ্ডল এক্সপ্রেস। বাংলা থেকে দক্ষিণ ভারত যাওয়ার জনপ্রিয়তম ট্রেনগুলির মধ্যে অন্যতম করমণ্ডল এক্সপ্রেস। বহু মানুষ প্রতি দিন ওই ট্রেনে চড়ে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় যান চিকিৎসা করাতে।
ঘড়ির কাঁটা তখন ৭টা পেরিয়েছে সদ্য। ওড়িশার বালেশ্বর স্টেশন পেরনোর পর আচমকাই বিকট শব্দ। ক্রমশ গতি কমতে থাকে করমণ্ডলের। একাধিক কামরা ডান দিকে হেলে পড়তে থাকে বিপজ্জনক ভাবে।
ট্রেনে উপস্থিত যাত্রীদের কয়েক জনের বক্তব্য, গতি কমার সঙ্গে সঙ্গেই কামরা হেলে যাওয়া টের পেতেই হুড়োহুড়ি শুরু কামরার মধ্যে। তত ক্ষণে আরও খানিকটা হেলে গিয়েছে কামরা। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, প্রায় এক কিলোমিটার পথ এ ভাবেই আস্তে আস্তে এগোতে থাকে ট্রেনটি।
করমণ্ডলের বেলাইন হওয়া কামরা গিয়ে পড়ে পাশের ডাউন লাইনের উপর। ডাউন লাইনের উপর আড়াআড়ি গিয়ে পড়ে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের কয়েকটি কামরা। তত ক্ষণে করমণ্ডল এক্সপ্রেস দাঁড়িয়ে পড়েছে।
জানা গিয়েছে, একটি মালগাড়ি করমণ্ডল এক্সপ্রেসের সামনে চলছিল। কোনও ভাবে করমণ্ডল এক্সপ্রেস সোজা গিয়ে ধাক্কা মারে সেই মালগাড়ির পিছনে।
মালগাড়ির পিছনে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ধাক্কার অভিঘাত এতটাই বেশি ছিল যে, এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন মালগাড়ির কামরার উপরে উঠে যায়। পিছনে বেলাইন হয়ে পড়ে এক্সপ্রেস ট্রেনটির বেশির ভাগ কামরা।
সেই সময়ই উল্টো দিক থেকে আসছিল বেঙ্গালুরু থেকে হাওড়াগামী একটি এক্সপ্রেস ট্রেন। যা লাইনের উপর আড়াআড়ি ভাবে পড়ে থাকা করমণ্ডল এক্সপ্রেসের কয়েকটি কামরার উপর দিয়ে চলে যায়।
ডাউন লাইনে পড়ে থাকা করমণ্ডলের কামরার সঙ্গে সংঘর্ষে বেলাইন হয়ে যায় হাওড়াগামী এক্সপ্রেস ট্রেনের একাধিক কামরা। ছিটকে পড়েন ট্রেনের ভিতরে থাকা যাত্রীরা।
দুর্ঘটনার অন্য একটি ব্যাখ্যাও পাওয়া যাচ্ছে। রেলকর্মীদের একটি অংশের দাবি, প্রথমে বেলাইন হয় বেঙ্গালুরু থেকে হাওড়াগামী এক্সপ্রেস ট্রেনটি। হাওড়াগামী ট্রেনের কয়েকটি কামরা আপ লাইনে এসে পড়ে আড়াআড়ি ভাবে।
সেই সময় আপ লাইনে ছুটে আসছিল করমণ্ডল এক্সপ্রেস। হাওড়াগামী ট্রেনের বেলাইন হয়ে যাওয়া কামরার সঙ্গে সংঘর্ষ হয় দ্রুত গতিতে ছুটে আসা করমণ্ডল এক্সপ্রেসের।
এতে করমণ্ডল এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়ে অন্য পাশের লাইনে (থার্ড লাইন) দাঁড়িয়ে থাকা মালগাড়িতে ধাক্কা মারে। ধাক্কার অভিঘাতে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন মালগাড়ির উপরে উঠে যায়।
দুর্ঘটনার জেরে ট্রেনের যাত্রীদের মধ্যে একটি অংশ আটকে পড়েন ছিটকে পড়া কামরার মধ্যেই। প্রাথমিক ভাবে ট্রেনের যাত্রীরাই উদ্ধারকাজ শুরু করেন। অন্ধকারে সমস্যা বাড়ে।
দুর্ঘটনা যে এলাকায় হয়েছে সেই এলাকাটি নির্জন। ফলে দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই স্থানীয় মানুষ ছুটে এসে উদ্ধারকাজে নামতে পারেননি। কিন্তু একটু সময় যেতেই হাজির হতে থাকেন আশপাশের বাসিন্দারা।
ট্রেনের যাত্রীদের সঙ্গে উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন স্থানীয়রা। কিন্তু সেই সময় মূল সমস্যা হয় আলোর অভাব। ট্রেনের কোনও আলো জ্বলছে না। তার উপর নির্জন এলাকা হওয়ায় নেই কোনও পথবাতিও।
টর্চ এবং মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে শুরু হয় উদ্ধারকাজ। প্রত্যক্ষদর্শীরা দেখতে পান, এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে দেহাংশ, যাত্রীদের জিনিসপত্র, খাবার। সেই সঙ্গে বিভিন্ন কামরা থেকে ভেসে আসতে থাকে কান্না, চিৎকারের শব্দ।
কিছু ক্ষণের মধ্যেই অবশ্য অকুস্থলে এসে পৌঁছয় রেলের উদ্ধারকারী দল। নেমে যায় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় শুরু হয় উদ্ধারকাজ।
ওড়িশায় দুর্ঘটনার জেরে হাওড়া, শালিমার থেকে দক্ষিণ ভারতগামী সমস্ত ট্রেন বাতিল করে দেওয়া হয়। রেল সূত্রে দাবি, ৫১টি ট্রেন ঘুরপথে বা সংক্ষিপ্ত পথে চালানো হচ্ছে। কিছু ট্রেনের যাত্রাপথও বদলে দেওয়া হয়।
বাতিল-হওয়া ট্রেনগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য পুরীগামী আপ জগন্নাথ এক্সপ্রেস, আপ পুরী এক্সপ্রেস, যশবন্তপুর এক্সপ্রেস, চেন্নাই মেল। শিয়ালদহ-পুরী দুরন্ত এক্সপ্রেসও বাতিল করা হয়েছে। হাওড়ার শালিমার স্টেশন থেকে শালিমার-পুরী ধৌলি এক্সপ্রেস এবং শালিমার-হায়দরাবাদ ইস্ট কোস্ট এক্সপ্রেস বাতিল করা হয়েছে।