দলাই লামার উপর নজরদারি বৃদ্ধি করেছে ভারত এবং চিন। সম্প্রতি নিজের অরুণাচল সফর বাতিল করেছেন অশীতিপর বৌদ্ধ ধর্মগুরু।
তাঁর এই সফর বাতিলের কারণ নিয়ে নানা রকম জল্পনা শুরু হয়েছে। তিব্বতের নির্বাচিত সরকার এবং দলাই লামার দফতরের তরফে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, শারীরিক অসুস্থতার কারণেই সফর স্থগিত রেখেছেন প্রবীণ বৌদ্ধ ধর্মগুরু।
একই সঙ্গে দলাই লামার ভক্ত এবং অনুরাগীদের আশ্বস্ত করে এ-ও জানানো হয়েছে যে, তাঁর শারীরিক পরিস্থিতি ‘গুরুতর’ নয়। চতুর্দশ দলাই লামার অরুণাচল সফর বাতিলের নেপথ্যে সম্ভাব্য দু’টি কারণ থাকতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
অরুণাচলকে লক্ষ্য করে ক্রমশ সামরিক আগ্রাসন বৃদ্ধি করছে চিন। কিছু দিন আগেই বেজিং অরুণাচল প্রদেশকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করেছে। অরুণাচলের নাম দেওয়া হয়েছে জাংনান, যার অর্থ দক্ষিণ তিব্বত।
অরুণাচলের গ্রামগুলির নিজস্ব নামকরণও করেছে চিন। এই নিয়ে চিনের বিদেশ মন্ত্রকের কাছে নিজেদের প্রতিবাদ বার্তা পাঠিয়েছে ভারত।
এই আবহে দলাই লামা অরুণাচল যাওয়ার ঝুঁকি নিতে চাইলেন না বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, সে ক্ষেত্রে নয়াদিল্লি এবং বেজিংয়ের সম্পর্ক আরও তলানিতে নামতে পারত।
১৯৫১ সাল থেকে অধুনা চিন নিয়ন্ত্রিত তিব্বতে আলাদা সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দলাই লামা। তিব্বতের স্বায়ত্তশাসনের দাবি উড়িয়ে চিন সরকার গ্রেফতার করতে চায় দলাই লামাকে।
১৯৫৯ সালে চিন প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে তিনি ভারতে আসেন। ভারত তাঁকে আশ্রয় দেয়। পৃথক রাষ্ট্রের দাবিতে, তিব্বতের স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে গোটা বিশ্বে প্রতিবাদ করে চলেছেন তিব্বতিরা।
অন্য আর একটি সম্ভাবনার কথাও মাথায় রাখছেন ভারত এবং চিনের কূটনীতিকেরা। মনে করা হচ্ছে, দলাই লামা সাধারণ জ্বরে কাবু হয়ে পড়েছেন বলে দাবি করা হলেও, তিনি শারীরিক ভাবে বেশ অসুস্থ।
৮৮ বছরের দলাই লামার অবর্তমানে পরবর্তী দলাই লামা কে হবেন, তা নিয়েই ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে বেজিং এবং নয়াদিল্লিতে।
বেজিং প্রশাসনের একটি সূত্র বলছে, চতুর্দশ দলাই লামার মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারী চয়ন নিয়ে ডামাডোল তৈরি হতে পারে। সেই সুযোগ নিয়ে মূলত চিন অনুগামী কোনও তিব্বতি নেতাকে পরবর্তী দলাই লামা হিসাবে তুলে ধরতে চাইবে চিন।
তবে সে ক্ষেত্রে ‘ড্রাগনের দেশ’ তিব্বতি বৌদ্ধদের সমর্থন কতটা পাবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ, ভারতে বসবাসকারী প্রায় ২০ হাজার বৌদ্ধ ধর্মগুরু এই বিষয়ে নয়াদিল্লির দিকেই চেয়ে রয়েছেন।
নির্বাসিত তিব্বতি সরকারের প্রধান পেনপা জ়েরিং সেপ্টেম্বর মাসেই জানিয়েছিলেন যে, তাঁরা আশা করেন, পরবর্তী দলাই লামার প্রতিও নয়াদিল্লি একই ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে।
চিনকে যে তাঁরা এই বিষয়ে ভরসা করেন না, তারই যেন ইঙ্গিত আছে ওই মন্তব্যে। দলাই লামা এর আগে জানিয়েছিলেন, ১১৩ বছর বাঁচার সম্ভাবনা থাকলেও ৯০ বছর বয়সেই তিনি তাঁর উত্তরাধিকারীকে বেছে নেবেন।
সে কথা ধরলে আগামী দু’বছরের মধ্যেই পঞ্চদশ দলাই লামার নাম জেনে যাওয়ার কথা গোটা বিশ্বের। তবে তার আগেই চিন এবং ভারত এই প্রক্রিয়ার দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
গত এপ্রিল মাসে অরুণাচলের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু দলাই লামার অরুণাচল সফরের কথা জানিয়েছিলেন। অক্টোবরের শেষ থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে তাঁর এই সফরে যাওয়ার কথা ছিল।
দলাই লামার অফিসের তরফে জানানো হয়, চিকিৎসকেরা বৌদ্ধগুরুকে কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলতে বলেছেন। অরুণাচল সফরের আগে ১৬ থেকে ২২ অক্টোবরের মধ্যে সিকিম এবং বাংলা সফরেও আসার কথা ছিল দলাই লামার।
কিন্তু সিকিমে বন্যা পরিস্থিতি এবং দলাই লামার শারীরিক পরিস্থিতির কারণে সেই সফরও বাতিল করা হয়। তিব্বত সরকারের এক মুখপাত্রের অবশ্য দাবি, অরুণাচল সফরের কথা অনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণাই করা হয়নি।
চিনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত সংঘাতের আবহে দলাই লামার ‘স্পর্শকাতর’ অরুণাচল সফর বাতিলকে তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে। বয়স এবং শারীরিক কারণে নিজের কাজকর্মের পরিধি অনেকটাই কমিয়ে এনেছিলেন প্রবীণ এই ধর্মগুরু। তবে ভারত সরকার আগেই জানিয়েছিল যে, দেশের যে কোনও প্রান্তে স্বচ্ছন্দে যেতে পারেন তিনি।