লাখ লাখ টাকার জন্য অপহরণ ঠিকাদারকে। নেপথ্যে ছিল পেশাগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আর এই সব কিছু পুলিশ ধরে ফেলল অপহরণের মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। দ্রুত এই তদন্তের নিষ্পত্তির নেপথ্যে রয়েছেন এক মহিলা এসপি। নাম সাগরিকা নাথ। এই প্রথম নয়, এ রকম কামাল নাকি আগেও তিনি করেছেন।
ঘটনাটি ওড়িশার বালেশ্বরের। শিবানন্দ পাত্র নামে এক ঠিকাদারকে অপহরণ করা হয়েছিল। শিবানন্দ চন্দনেশ্বরের বাসিন্দা। অপহরণকারীরা ৪০ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ চেয়েছিলেন।
তাঁর স্ত্রী টাকা প্রায় মিটিয়েও দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অপহরণকারীদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে দেন এসপি সাগরিকা। অভিযুক্তদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ধরে ফেলে পুলিশ। এক জন গ্রেফতারও হয়েছেন। আটক এক জন।
এসপি সাগরিকা নাথ জানিয়েছেন, গত বুধবার তালসারি থানায় অভিযোগ জানিয়েছিলেন শিবানন্দের স্ত্রী নীরাবালা কুণ্ডু। জানিয়েছিলেন, তাঁর স্বামী অপহৃত হয়েছেন। অপহরণকারীরা ৪০ লক্ষ টাকা চেয়েছেন।
নীরাবালা জানান, তিনি নগদ পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন অপহরণকারীদের। বাকি ৩৫ লক্ষ টাকা চেকে দিয়েছিলেন। তার পরেও সুরাহা হয়নি। অগত্যা অভিযোগ জানাতে থানায় আসেন।
মামলা দায়েরের পর পুলিশ তদন্তে নামে। জানতে পারে, লাল গাড়িতে চেপে এসে কয়েক জন অপহরণ করেন শিবানন্দকে। সেই লাল গাড়ির খোঁজ শুরু হয়।
পুলিশের তরফে দু’টি দল গড়া হয়। সাইবার অপরাধ দমন শাখাকে নিয়ে তৈরি হয় একটি দল। অন্যটিতে ছিলেন তালসারি থানার সদস্যেরা। একটি দল ছোটে ময়ূরভঞ্জ। অন্য একটি দল যায় বালেশ্বরে।
অপহরণকারীরা যে নম্বর থেকে ফোন করে মুক্তিপণ চেয়েছিলেন, সেই ফোনে আড়ি পাতা হয়। পুলিশ জানতে পারে, বালেশ্বর স্টেশনের কাছে কোনও একটি হোটেল থেকে করা হয়েছিল সেই ফোন। এর পর বালেশ্বরের ওই হোটেলে গিয়ে তল্লাশি শুরু করে পুলিশ। বৃহস্পতিবার তারা তল্লাশি চালায়। তার পরেই আটক হন অপহরণকারীরা।
অপহরণকারীদের জেরা করে পুলিশ জানতে পারে, এ সবের নেপথ্যে রয়েছেন আর এক ঠিকাদার সুমন বরুণ দে। তিনি বালেশ্বরের বাসিন্দা। অপহৃত শিবানন্দ তাঁর পরিচিত ছিলেন। বহু বছর ধরে একে অপরকে চিনতেন তাঁরা।
কেন শিবানন্দকে অপহরণ করিয়েছিলেন সুমন, খতিয়ে দেখছে পুলিশ। এসপি সাগরিকার প্রাথমিক অনুমান, পেশাগত প্রতিদ্বন্দ্বিতাই কারণ। যে ভাবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শিবানন্দকে উদ্ধার করেছে পুলিশ, তাতে প্রশংসা কুড়িয়েছেন সাগরিকা।
আটক হওয়ার পর সুমন যদিও দাবি করেছেন, তিনি শিবানন্দকে অপহরণ করেননি। শিবানন্দ তাঁর থেকে টাকা ধার নিয়েছিলেন। কিন্তু ফেরত দিচ্ছিলেন না। তা বলে তিনি মোটেও অপহরণ করেননি। সুমনের কথায়, ‘‘গত ২৪ ঘণ্টা আমরা দু’জনে একসঙ্গে ছিলাম। ভাল সময় কাটিয়েছি।’’
নিমেষে তদন্তের সমাধান আগেও করেছেন সাগরিকা। সেই নিয়ে পুলিশে তাঁর যথেষ্ট সুনামও রয়েছে। তবে জানিয়েছেন, এই অপহরণ নিয়ে তদন্ত এখনও শেষ হয়নি।
২০১৬ ব্যাচের আইপিএস সাগরিকার ঝুলিতে এ রকম অভিজ্ঞতা অনেক। আইপিএস নিযুক্ত হওয়ার পর তৃতীয় দিনেই গাঁজার বড়সড় চক্র ধরেছিলেন তিনি। সহযোগিতা করেছিল এসটিএফ। এক টন গাঁজা উদ্ধার হয়েছিল সেই অভিযানে। গ্রেফতার হয়েছিলেন ১৪৭ জন।
সাফল্য বরাবরই হাত ধরাধরি করে চলেছে সাগরিকার। ওড়িশা ক্যাডারের আইপিএস সাগরিকা ইউপিএসসি পরীক্ষায় ১৯৯ র্যাঙ্ক করেছিলেন। হতে পারতেন আইএএস। যদিও আইপিএসই বেছে নেন।
ছোট থেকে এই ইচ্ছাই ছিল সাগরিকার। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলোয় বরাবর ভাল ছিলেন। ক্যারাটেও শিখছেন। পাশাপাশি ওড়িশি নাচেরও তালিম নিয়েছেন। কবিতা তাঁর খুব প্রিয়। অবসরে নাচ এবং কবিতা নিয়েই সময় কাটান।
১০০ মিটার দৌড়ে নিজের রাজ্য ওড়িশার প্রতিনিধিত্ব করেছেন সাগরিকা। জাতীয় স্তরে লং জাম্প প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। ক্যারাটেতেও ব্ল্যাক বেল্ট পেয়েছেন সাগরিকা। বাইক চালানো তাঁর অন্যতম শখ। বাইকে চেপে পাড়ি দিয়েছেন লাদাখ। সমাজমাধ্যমে সেই পোস্টও দিয়েছেন।
সাগরিকার বাবা ঢেঙ্কানল জেলার কুশপাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা। পেশায় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। ভুবনেশ্বরের এনএএলসিও-তে সিনিয়র ডেপুটি ম্যানেজার পদে কাজ করতেন।
বাবার মতো সাগরিকাও ইঞ্জিনিয়ার। তবে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছিলেন আইপিএস হবেন বলেই। সাগরিকা নিজেই জানিয়েছেন, ইউপিএসসি পরীক্ষায় অপশনাল বিষয় ছিল ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। যদিও দিল্লিতে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে বুঝেছিলেন, আইপিএস হওয়া অত সহজ নয়। একটি সাক্ষাৎকারে নিজেই জানিয়েছেন সে সব।
আইপিএস হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন মামা সুশান্তকুমার নাথ। তাঁর মতো আইপিএস হওয়ার দিকেই ঝুঁকেছেন। সুশান্ত ওড়িশা পুলিশে আইজি পদে কাজ করেছেন। কটকে নিযুক্ত ছিলেন।
সাগরিকা একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, পুলিশ আর সাধারণ মানুষের মধ্যে সব সময় একটা দূরত্ব থেকে গিয়েছে। পরস্পরের প্রতি একটা ‘অবিশ্বাস’ কাজ করে। আইপিএস নিযুক্ত হওয়ার পর প্রথম দিন থেকে এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন। জোর দিয়েছেন ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ পুলিশি নীতিতে।
সাগরিকা মনে করেন, তিনি পুলিশ বাহিনী নয়, আদতে ‘জন বাহিনী’-তে রয়েছেন। তিনি নিযুক্ত হয়ে মহিলাদের জন্যও বেশ কিছু কাজ করেছেন। কোরাপুটে নিযুক্ত থাকাকালীন মহিলা হেল্পলাইন ‘মিশন জাগৃতি’, অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড চালু করেছেন তিনি। মহিলাদের নিরাপত্তার জন্য পথে টহলের ব্যবস্থাও করেছেন। আর এই সমস্ত ব্যবস্থার মাথায় রয়েছেন সাগরিকাই।