মেটাভার্স এমন এক ভার্চুয়াল দুনিয়া, যেখানে অগমেন্টেড রিয়্যালিটি, ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি, হলোগ্রামের থ্রি-ডি অবতার, ভিডিয়ো এবং জনসংযোগের মিলন ঘটেছে। এখানে ব্যবহারকারীদের প্রত্যেকের একটি করে ‘থ্রিডি ভার্চুয়াল’ রূপ থাকবে। সেই ভার্চুয়াল রূপ বাস্তবের মানুষটির প্রতিনিধিত্ব করবে ভার্চুয়াল দুনিয়ায়।
উন্নত প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এই দুনিয়াকে শিল্পকলা, জমি কেনাবেচা, ক্রিপ্টোকারেন্সি ইত্যাদি নানা কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
মার্ক জাকারবার্গের সংস্থা এটিকে সর্বসাধারণের ব্যবহারযোগ্য করে তোলার সব রকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মেটাভার্সের সুরক্ষা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। এরই মধ্যে নানা অপরাধের খবর সামনে আসতে শুরু করেছে।
সম্প্রতি মেটাভার্সে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করলেন এক মহিলা। ব্রিটিশ নাগরিক নিনা জেন পটেলের অভিযোগ, তিনি ‘মেটা’-র ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্ম ‘হরাইজন ওয়ার্ল্ড’-এ গণধর্ষণের শিকার।
নেটমাধ্যমে এ বিষয়ে একটি পোস্টও করেন নিনা। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘হরাইজন ওয়ার্ল্ডে যোগ দেওয়ার এক মিনিটের মধ্যে আমাকে যৌন হেনস্থার শিকার হতে হয়। তিন-চার জন পুরুষ অবতার, যাদের গলার স্বরও পুরুষের ছিল, তাঁরা আমাকে ভার্চুয়ালি ধর্ষণ করেন এবং ছবি তুলে নেন।’ নিনা আরও লিখেছেন, ‘ঘটনার সময় ওই অবতারদের ব্লক ও রিপোর্ট করার চেষ্টাও করেও সফল হইনি।’ শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের ভার্চুয়াল রিয়ালিটি হেডসেটটি খুলে ফেলতে বাধ্য হন এবং সেটিকে বন্ধ করে দেন।
নিনা একটি সংস্থার সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট। সংস্থাটি মেটাভার্সের ওপর গবেষণা চালায়। সংস্থার মূল লক্ষ্য বাচ্চাদের জন্য একটি সুরক্ষিত ডিজিটাল দুনিয়া তৈরি করা।
নিনার পোস্টে অনেকে লিখেছেন, তিনি পাত্তা পাওয়ায় জন্য এ সব বলছেন। অনেক লিখেছেন, ‘ভার্চুয়াল দুনিয়ায় এই ঘটনা ঘটেছে। চিন্তা করার কিছু নেই।’ এমনকি অনেকে তাঁকে মহিলা অবতার ধারণ করতে মানা করেছেন যাতে ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া যায়।
নিনার অভিযোগ পাওয়ার পরই পদক্ষেপ করে মেটা। তারা প্রতিটি অবতারের চারিদিকে অদৃশ্য একটি সুরক্ষা বলয় তৈরি করে দিয়েছে। এই বলয়ের ব্যাসার্ধ প্রায় চার ফুট। কেউ এই বলয় লঙ্ঘন করতে চাইলে মেটা সেই অবতারকে তৎক্ষণাৎ ‘ফ্রিজ’ করে দেবে। এই বলয়ের ব্যবহার যাতে খুব সহজ ভাবে করা যায় সেই ব্যবস্থাও করেছে সংস্থা।
ত্রিমাত্রিক জগৎ যত বিস্তৃত হচ্ছে, বড় বড় সংস্থাগুলি তত চেষ্টা করে যাচ্ছে বাস্তব জগতের সমস্ত অনুভূতি এই জগতে তৈরি করতে। ইমার্জ নামে একটি সংস্থা ইতিমধ্যেই মেটাভার্সে এই প্রযুক্তি নিয়ে চলে এসেছে। যার মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা খালি হাতে স্পর্শের অনুভূতি পেতে পারবেন।
নেট বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশের আশঙ্কা, মেটাভার্স যৌন অপরাধীদের জন্য একটি মুক্তাঞ্চলে পরিণত হতে পারে এবং তা রুখতে সরকারকে দ্রুত আইন সংশোধন করতে হবে।
তাঁদের মতে, ভারতে অনলাইন হয়রানির শিকারদের অনেকে। তাঁরা ভারতীয় দণ্ডবিধি (আইপিসি) ধারা ৩৫৪এ, ৩৫৪ডি, ৪৯৯, ৫০৭, ৫০৮ ইত্যাদি এবং তথ্য প্রযুক্তি আইনের ধারা ৬৬সি, ৬৬ডি, ৬৬ই, ৬৭ এবং ৬৭এ-র মধ্যে যে কোনও আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। কিন্তু মেটাভার্সে হয়রানির জন্য কোনও অবতারকে কোন আইনে দণ্ড দেওয়া হবে তা নির্ণয় করা কঠিন। কারণ, এখানে সরাসরি স্পর্শের কোনও ব্যাপার নেই এবং এই অবতারগুলি যে কেউ হতে পারে। কোনও প্রাপ্তবয়স্ক একটি বাচ্চা বা কোনও মহিলার অবতারও গ্রহণ করতে পারে। কোনও সংস্থার কাছে এখনও অবধি কোনও অবতারের পরিচয়ের সত্যতা নির্ণয়ের উপায়ও নেই।
মেটাভার্স, যা কিনা একটি ডিজিটাল দুনিয়া সেখানেও অনেককে বাস্তব দুনিয়ার সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বাস্তব দুনিয়ার মতে এখানেও হেনস্থার শিকারিদের হেনস্থার প্রমাণ জোগাড় করতে হচ্ছে নিজেদের রক্ষা করার তাগিদে। বাস্তব সমাজে অনেক লড়াইয়ের পর এই ধরনের আলোচনা মূল স্রোতে জায়গা করে নিলেও, মেটাভার্সের মতো নতুন দুনিয়ার ক্ষেত্রে তা এখনও অনেক দেরি।
নিনার অভিযোগ চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল যে ডিজিটাল দুনিয়ায় গ্রাহকদের হেনস্থার হাত থেকে বাঁচাতে এবং একটি সুন্দর পরিবেশ গড়ে তুলতে সবক’টি সংস্থাকে একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে।