জীবনে তিনি ধাক্কা খেয়েছিলেন বহু বার। বহু দরজা তাঁর মুখের উপর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অবসাদে ভুগেছিলেন। আত্মঘাতী হওয়ারও চেষ্টা করেছিলেন। যখন অবসর নিয়েছিলেন, তখন তাঁর মতো সুখী মানুষ কমই ছিলেন। কোটিপতি হয়ে শেষ করেছিলেন কর্মজীবন। তিনি কর্নেল হারল্যান্ড স্যান্ডার্স। কেএফসি (কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন)-র জনক।
কেএফসির বিজ্ঞাপনে সাদা দাড়ির সেই মানুষটিই হলেন স্যান্ডার্স। এখন প্রায় গোটা দুনিয়ার শহুরে মানুষ তাঁকে চিনে ফেলেছেন। কিন্তু এই সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে বিশাল এক ব্যর্থতার ইতিহাস।
স্যান্ডার্সের বয়স যখন ৬ বছর, তখন তাঁর বাবা মারা যান। ওই বয়সেই নিজে রান্না করতেন তিনি। ভাইবোনেদের দেখভাল করতেন। সপ্তম শ্রেণির পর আর পড়াশোনা করা হয়নি। চাষের কাজে নিযুক্ত হন তিনি।
বয়স লুকিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন স্যান্ডার্স। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৬ বছর। পরের বছরই তাঁকে সসম্মানে সেনাবাহিনী থেকে মুক্ত করা হয়। তিনি শ্রমিক হিসাবে রেলের কাজে যোগ দেন।
সেই চাকরিও হারান স্যান্ডার্স। সহকর্মীদের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল। তার জেরে চাকরি যায়। তবে সে সময় তিনি আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন।
তবে আইনজীবী হয়ে বেশি দিন সওয়াল করাও হয়নি স্যান্ডার্সের। বচসায় জড়িয়ে সেই কেরিয়ারও যায়। এর পর মায়ের কাছে ফিরে আসেন স্যান্ডার্স। বিমার এজেন্ট হয়ে কাজ শুরু করেন।
সেই চাকরিও চলে যায় স্যান্ডার্সের। মালিকের কথা শোনেননি। এই ছিল ‘দোষ’। ১৭ বছর যখন তাঁর বয়স, তত দিনে চারটি চাকরি হারিয়েছেন স্যান্ডার্স।
স্যান্ডার্স থামেননি। একটা চাকরি যেত। অন্য চাকরিতে যোগ দিতেন। এই ভাবেই অবসাদে ভুগতে থাকেন তিনি। আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন।
এত বার ধাক্কার পর স্যান্ডার্স বুঝতে পারেন, তিনি একটা বিষয়েই দক্ষ— রান্না। ঠিক করেন, একটি দোকান খুলবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। খুলেও ফেলেন।
টেনিসির কাছে করবিনে একটি পেট্রল পাম্পে খাবারের দোকান খুলেছিলেন তিনি। সেটাই ছিল কেএফসির প্রথম বিপণি। সেখানে নিজের তৈরি চিকেন ফ্রাই বিক্রি করতেন। সঙ্গে সস, যার রেসিপি ছিল গোপন।
ধীরে ধীরে ক্রেতাদের দারুণ পছন্দ হয়ে গেল স্যান্ডার্সের তৈরি চিকেন ফ্রাই। জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে স্যান্ডার্সের। ক্রেতার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ছোট দোকানে সমস্যা দেখা দেয়। তিনি পেট্রল পাম্পের কাছে একটি ‘মোটেল’ খোলেন।
সেই ‘মোটেল’ আরও জনপ্রিয় হয়। কেন্টাকির গভর্নর তাঁকে ‘কর্নেল’ খেতাব দেন। গোটা স্টেটে ছড়িয়ে পড়ে স্যান্ডার্স এবং তাঁর চিকেন ফ্রাইয়ের নাম।
তবে সেই সাফল্যও দীর্ঘ হয়নি। স্যান্ডার্সের দোকানে এতটাই ভিড় হতে শুরু করে যে, ওই রাস্তায় যানজট তৈরি হয়। তাঁকে প্রশাসনের তরফে সরে যেতে বলা হয়। ক্রেতারাও দূরে সরে থাকেন। ধারে ডুবতে থাকেন স্যান্ডার্স। নিজের জমানো টাকা দিয়ে ধার মেটাতে থাকেন।
নিজের দেনা মেটানোর জন্য গ্রাহক খুঁজতে থাকেন স্যান্ডার্স। নিজের পেনশনটুকু ছাড়া তখন তাঁর হাতে কিছুই ছিল না। সেই সঙ্গে নিজের চিকেন ফ্রাইয়ের রেসিপিও বিক্রির চেষ্টা করেন। আমেরিকার ১০০৮টি রেস্তরাঁ সেই রেসিপি কিনতে অস্বীকার করেছিল। রাজি হয় ১০০৯তম রেস্তরাঁ।
ওই রেস্তরাঁ স্যান্ডার্সের প্রস্তাব মেনে নেয়। তার আগে কয়েক বছরে বার বার বদলেছেন সেই রেসিপি। সংযোজন করেছেন নানা মশলা। তিনি নিজেই জানিয়েছেন, ১১ রকম মশলা, ভেষজ দিয়ে তৈরি করেছিলেন চিকেন ফ্রাই।
ক্রেতারা সেই রেস্তরাঁয় আবার ভিড় জমাতে থাকেন স্যান্ডার্সের তৈরি চিকেন খেতে। বিক্রি হওয়া প্রতি টুকরো চিকেনের জন্য রেস্তরাঁর মালিক টাকা দিতেন স্যান্ডার্সকে। এই ছিল চুক্তি।
চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে স্যান্ডার্সের তৈরি চিকেনের। একে একে একশোটি বিপণিকে ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি দেন স্যান্ডার্স। কোটিপতি হন তিনি। নিজের ব্যবসা সংস্থার মুখপাত্র জুনিয়র জন ব্রাউনকে বিক্রি করতে রাজি হন। তবে শর্ত দেন, তাঁকেই মুখপাত্রের কাজ করতে হবে।
২০ লক্ষ ডলারে বিক্রি করেছিলেন ব্যবসা। ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১৬ কোটি টাকা। এখন ১১৫টি দেশে রয়েছে কেএফসি। দুনিয়ার ফাস্ট ফুড সংস্থাগুলির মধ্যে অন্যতম। স্যান্ডার্স ব্যর্থতা কাটিয়ে ঘুরে না দাঁড়ালে এই সাফল্য আসত না।