১৯৩২ সালে লস অ্যাঞ্জেলস অলিম্পিক্সে পদকপ্রাপ্তির নিরিখে একেবারেই সাফল্যের মুখ দেখেননি ব্রাজিলের অ্যাথলিটরা। তা সত্ত্বেও অলিম্পিক্সের কিংবদন্তিতে অমর হয়ে রয়েছেন তাঁরা। সেই সঙ্গে কফির ইতিহাসেও জ্বলজ্বল করছে তাঁদের নাম। কেন? কফির ইতিহাসের সঙ্গে ১৯৩২-এর ব্রাজিলীয় অলিম্পিক্স দলেরই বা কী সম্পর্ক?
আসলে লস অ্যাঞ্জেলসে অলিম্পিক্সের আসরে পৌঁছতে ব্রাজিলীয় অ্যাথলিটদের রসদ জুগিয়েছিল কফি। সেখানে পৌঁছতে কফিও বিক্রি করতে হয়েছিল তাঁদের। তাঁদের সেই সফরের কাহিনিই এই প্রতিযোগিতার ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে।
১৯৩২ সালে বিশ্বে কফি উৎপাদনকারী দেশ হিসাবে শীর্ষে ছিল ব্রাজিল। বিশ্বের ৮০ শতাংশ কফিই সরবরাহ করতেন সে দেশের কফি উ়ৎপাদনকারীরা। বস্তুত, ১৮৮০ থেকে ১৯৩০ সাল— এই ৫০ বছরে কফিকে কেন্দ্র করে ব্রাজিলের শিল্পক্ষেত্র দ্রুত গতিতে বেড়ে উঠেছিল। সে দেশের অর্থনীতিতেও তা সিংহভাগ জায়গা নিয়ে নিয়েছিল। ব্রাজিলের ইতিহাসে ওই ৫ দশক ‘কফি উইথ মিল্ক’ বলেও পরিচিত।
তবে তিরিশের দশকে মহামন্দার কবলে পড়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল আমেরিকা তথা বিশ্বের অর্থনীতি। ১৯২৯ থেকে ’৩৯ সাল পর্যন্ত মহামন্দার দাপট চলেছিল। তিরিশের দশকে যার ধাক্কায় বির্পযস্ত হয়েছিল ব্রাজিলের কফি শিল্পও। দুনিয়া জুড়ে কফির দাম হু হু করে পড়তে থাকে। ব্রাজিলের কফি উৎপাদনকারীদের সঙ্গে একের পর এক চুক্তি বাতিল করতে থাকেন বিশ্বের নানা দেশের বিক্রেতারা।
চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হওয়ায় বরাবরই সমস্যার মুখে পড়তেন ব্রাজিলের কফি উৎপাদকেরা। তবে মহামন্দার জেরে সে সমস্যা সঙ্কটে পরিণত হয়েছিল।
সঙ্কট মেটাতে ন্যাশনাল কফি কাউন্সিল গঠন করে ব্রাজিল সরকার। ব্রাজিলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেতুলিয়ো ভার্গাসের নির্দেশে সাও পাওলোর উৎপাদকদের থেকে কফি কিনতে শুরু করে ওই কাউন্সিল। এর পর সেই ফসলের বিনিময়ে আমেরিকা বা জার্মানির মতো দেশ থেকে পণ্য আমদানি করেছিল ব্রাজিল সরকার। যেমন, ১৯৩১ সালে কফির বিনিময়ে আমেরিকা থেকে গম এবং পরের বছর তার বদলে জার্মানির থেকে কয়লা আমদানি করেছিল ব্রাজিল।
চুক্তির মাধ্যমে নানা দেশে কফি বিনিময় করা হলেও ব্রাজিলে কফির ভাঁড়ার উপচে পড়ছে। ফলে বাধ্য হয়েই সেগুলি নষ্ট করার সিদ্ধান্ত নেয় কাউন্সিল। লক্ষ লক্ষ বস্তাভর্তি কফি পুড়িয়ে অথবা সমুদ্রে ফেলতে শুরু করে তারা।
মহামন্দার সময় ওই কফির ব্যাগগুলিই যে ব্রাজিলীয় অ্যাথলিটদের অলিম্পিক যাত্রায় রসদ জোগাবে, তা কে জানত! ১৯৩২ সালের জানুয়ারিতে ব্রাজিলের অলিম্পিক্স দল ঘোষণা করেছিল সে দেশের ন্যাশনাল স্পোর্টস ফেডারেশন। সেই সঙ্গে ওই দলকে আমেরিকার পাঠানোর জন্য একটি পরিকল্পনাও ছকে ফেলেছিল তারা। অলিম্পিক্সের আসরে জাতীয় দলের ত্রাতা হয়ে ওঠে কফি।
ফেডারেশনের পরিকল্পনা ছিল, একটি বাণিজ্যিক জাহাজ ভাড়া করে ব্রাজিলের অ্যাথলিটদের লস অ্যাঞ্জেলসে নিয়ে যাওয়া হবে। তবে সে খরচ তুলতে যাত্রাপথে বন্দরে বন্দরে জাহাজ নোঙর করে কফি বিক্রি করতে হবে অ্যাথলিটদের। বন্দরগুলি পেরিয়ে জাহাজ ক্যালিফোর্নিয়ায় পৌঁছলে সেখানেও কফি বিক্রির পরিকল্পনা ছিল ফেডারেশনের।
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে কফি কাউন্সিলের সহায়তা চেয়েছিল ফেডারেশন। কফি উৎপাদকেরাও হাজার হাজার বস্তাভর্তি কফি দান করেছিলেন। এ যেন এক ঢিলে দুই পাখি মারা! অ্যাথলিটরা আমেরিকায় অলিম্পিক্সের আসরে পৌঁছতে পারবেন। সেই সঙ্গে বিশ্ববাজারে পৌঁছে যাবে ব্রাজিলের কফি।
লস অ্যাঞ্জেলসে দশম অলিম্পিক্স আসরে অ্যাথলিটদের পৌঁছে দিতে ‘এসএস ইটাকুইস’ নামে একটি জাহাজ ভাড়া করেছিল ব্রাজিলের স্পোর্টস ফেডারেশন। ’৩২-এর ২৫ জুন যাত্রা শুরু করে ইটাকুইস।
অনেকের দাবি, তাতে ৮৭ জন অ্যাথলিটের সঙ্গে ফেডারেশন আধিকারিক-কর্মী মিলিয়ে ৯ জন ছিলেন। সঙ্গে ছিল তেরো সদস্যের সাংবাদিক দল। ওই জাহাজে নৌসেনার ব্যান্ডপার্টি ছাড়াও অ্যাথলিটদের বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সদস্যরা এবং দর্শকেরাও সওয়ার হয়েছিলেন।
তৎকালীন সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, জাহাজে ৫৫,০০০ কফির বস্তা তোলা হয়েছিল। অনেকের দাবি, সে সংখ্যাটি আসলে ৫০,০০০।
ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনেইরো থেকে যাত্রা শুরু করে পানামা খাল হয়ে আমেরিকা পৌঁছতে ১৩,৩২৮.৮৪ নটিক্যাল কিলোমিটার পার হতে হত জাহাজটিকে। স্থলপথে যা ১৩,৩২৮.৫৯ কিলোমিটারের সমান।
আমেরিকায় পৌঁছানোর আগে ত্রিনিদাদের পোর্ট অফ স্পেনের বন্দরে বেশ কিছু কফির বস্তা বিক্রির লক্ষ্য ছিল ব্রাজিলীয় অ্যাথলিটদের। তবে সেখানে পৌঁছলেও সে লক্ষ্যে সফল হতে পারেননি তাঁরা।
এর উপরে পামামা খাল পার করতে গিয়ে ট্রানজিট ফি দিতে হত জাহাজটিকে। তবে সে ফি এড়াতে অন্য পন্থা নিয়েছিলেন অ্যাথলিটরা। জাহাজে দু’টি কামান থাকায় অ্যাথলিটরা তর্ক জুড়েছিলেন, ইটাকুইস আসলে নৌবাহিনীর জাহাজ। ফলে ফি মকুব করা হোক। যদিও সে তর্ক বিফলে গিয়েছিল। পানামা খাল পার হতে রীতিমতো গাঁটের কড়ি খসাতে হয়েছিল তাঁদের।
১১ জুলাই পানামা খাল পার করার সময় বেশির ভাগ কফির বস্তাই অবিক্রিত থেকে গিয়েছিল। এরই মধ্যে প্রশান্ত মহাসাগরের বালবোয়া বন্দর দিয়ে যাওয়ার সময় সেখানকার ক্যানাল জ়োন স্ক্রাব টিমের বিরুদ্ধে প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলে নেয় ব্রাজিলের ওয়াটারপোলো দল। তাতে ২০-০ গোলে জিতেছিল তারা।
প্রায় ১ মাসের দীর্ঘ যাত্রার পর ২২ জুলাই সকাল পৌনে ৬টায় লস অ্যাঞ্জেলস বন্দরে পৌঁছয় ইটাকুইস। তবে সেখান থেকে অ্যাথলিটদের অলিম্পিক্স ভিলেজে পৌঁছতে গিয়ে অর্থকষ্ট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ব্রাজিলের ঘরের মাঠে সে সময় ভার্গাস সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে সাও পাওলো প্রশাসন। ৯ জুলাইয়ের ওই বিদ্রোহের জেরে ব্রাজিলের অ্যাথলিটদের খরচাপাতির জন্য অতিরিক্ত অর্থ পৌঁছনো দুষ্কর হয়ে পড়ে।
আমেরিকার মাটিতে নেমে যাত্রা শুরু করতে মাথাপিছু ১ ডলার করে ফি দিতে হত অ্যাথলিটদের। তবে জাহাজের ২৪ জন অ্যাথলিট সেই অর্থ জোগাড় করতে পেরেছিলেন। বাকিরা পরের দু’দিন ধরে গন্তব্যে পৌঁছান। তবে অন্তত ৩০ জন অ্যাথলিট ওই ফি জমা দিতে অসমর্থ হওয়ায় জাহাজ ছেড়ে নামতে পারেননি। ফলে সে বছরের মতো তাঁদের অলিম্পিক্সের স্বপ্ন অধরাই থেকে গিয়েছিল।
লস অ্যাঞ্জেলসের বন্দরে ২২,০০০ কফির বস্তা বিক্রি করতে পেরেছিলেন ব্রাজিলীয় অ্যাথলিটরা। তবে অর্ধেকের বেশি কফি তখনও অবিক্রিত ছিল। ফলে ২৫ জুলাই অলিম্পিক্স চলাকালীনই সেগুলি বিক্রির জন্য সান ফ্রান্সিসকোর উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল ইটাকুইস।
এরই মাঝে লস অ্যাঞ্জেলসের বন্দরে নোঙর করার জন্য ৬০০ ডলার দিতে পারেনি বলে ইটাকুইসের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয় শুল্ক দফতরের এক দালাল সংস্থা। সেই মামলার নিষ্পত্তিতে ১ সপ্তাহের বেশি পেরিয়ে যায়। ওই সময় সান ফ্রান্সিসকোর বন্দরে ইটাকুইসকে আটকে রাখা হয়েছিল।
মামলার নিষ্পত্তির পর শেষমেশ ৪ অগস্ট লস অ্যাঞ্জেলসে জাহাজটিকে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়। সান ফ্রান্সিসকোয় কিছু কফির বস্তা বিক্রি হলেও জাহাজে তখনও ৮,০০০ বস্তা পড়েছিল।
মাঠের বাইরে এই যুদ্ধের সময় অলিম্পিক্সের লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছিল। ৩১ জুলাই সেই প্রতিযোগিতার ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড ইভেন্ট-সহ সাঁতার, ওয়াটার পোলো, রোয়িং এবং শুটিংয়ে পদকের লড়়াই শুরু করেন অ্যাথলিটেরা। যদিও ওই অলিম্পিক্সে পদক জিততে পারেননি ব্রাজিলের কোনও প্রতিযোগী।
এই সফরে আরও এক কাহিনি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। ইটাকুইসে চড়ে যাত্রা করতে পারেননি ব্রাজিলের দৌড়বীর আদালবের্তো করদোসো। তবে অলিপিক্সের নামার জন্য সান ফ্রান্সিসকো থেকে নানা গাড়িতে বিনা ভাড়ায় চড়ে কোনও মতে লস অ্যাঞ্জেলসের স্টেডিয়ামে পৌঁছন। তাঁর ১০,০০০ মিটার দৌড়ের ইভেন্ট শুরুর মাত্র ৪ মিনিট আগে। স্বাভাবিক ভাবেই সকলের শেষে সে দৌড় শেষ করেন করদোসো। তবে দর্শকেরা তাঁর দৃঢ়তাকে কুর্নিশ জানিয়েছিলেন।
ব্রাজিলীয়রা সেই অলিম্পিক্সে কোনও পদক জেতেননি বটে। তবে দর্শকদের মন জয় করেছিলেন। অর্থকষ্ট, গৃহযুদ্ধ উপেক্ষা করেও অলিম্পিক্সের ময়দানে নেমেছিলেন তাঁরা। ১৯ অগস্ট রিওর পথে রওনা দিয়েছিল ইটাকুইস। তত দিনে জাহাজের সমস্ত কফির বস্তা বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।