সেই হাঁকডাক, চিৎকার করে খদ্দের ডাকা, দরদাম— এ সব হয়তো আর শোনা যাবে না। খুব শীঘ্রই ভোল বদলাতে চলেছে মুম্বইয়ের বিখ্যাত চোর বাজার। তার জায়গায় মাথা তুলতে পারে ঝাঁ-চকচকে শপিং কমপ্লেক্স।
সস্তার চটি থেকে রঙচঙে টিশার্ট, ফুলদানি থেকে ব্যাগ— পকেটে কম রেস্ত থাকলেও চোর বাজারে এসে অনায়াসে এ সব কেনা যায়। কিন্তু সেই দিন সম্ভবত শেষ হতে চলেছে।
ইতিহাসের খোঁজেও বহু মানুষ ঢুঁ দেন এই চোর বাজারে। প্রাচীন আমলের স্মারক, ঘর সাজানোর থেকে নিত্য ব্যবহারের জিনিস, সবই মেলে এই চোর বাজারে।
রাজা থেকে বলিউড অভিনেতা, এমনকি হলিউডের অভিনেতারাও অতীতে বিভিন্ন সময়ে ঢুঁ দিয়েছেন মুম্বইয়ের চোর বাজারে। কিনে নিয়ে গিয়েছেন ‘অ্যান্টিক’ জিনিসপত্র। এই চোর বাজার থেকে কেনা জিনিসপত্র ব্যবহার হয়েছে বলিউডি ছবিতেও।
একটি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ভেন্ডি বাজারের ১৬.৫ একর জমি অধিগ্রহণ করেছে সইফি বুরহানি আপলিফমেন্ট ট্রাস্ট। সেখানে নতুন প্রকল্প হবে। ঝাঁ-চকচকে শপিং মল হবে। তার পরেই জল্পনা, চোর বাজারও যে কোনও দিন বন্ধ হতে পারে। হারাতে পারে নিজের পরিচিত সত্তা।
ভেন্ডি বাজারের ১২২টি দোকান অধিগ্রহণ করেছে ওই সংস্থা। আশঙ্কা, চোর বাজারের দোকানেও কোপ পড়তে পারে। এর মধ্যেই বহু দোকানের মালিক এখানকার পাট চুকিয়ে গোয়া, উদয়পুর, পুণে চলে গিয়েছেন। সেখানেই শুরু করেছেন ব্যবসা।
চোর বাজারে আসবাবের দোকান রয়েছে আসিফ ভাইয়ের। তাঁর খদ্দের ছিলেন শাহরুখ খান থেকে মরক্কোর রাজা। দোকানে এমন সব অ্যান্টিক আসবাব রয়েছে, যা নাকি গোটা দেশে পাওয়া যায় না। মোঘল আমলের আসবাবও নাকি খোঁজ করলে তাঁর দোকানে পাওয়া যেতে পারে।
আসিফ বলেন, ‘‘চোর বাজার এখন শেষ। এর পুনর্নির্মাণ হলে আর কিছু বেঁচে থাকবে না। ওই যুগটাই শেষ হয়ে গেল।’’
চোর বাজারে আসিফের দোকানে মিলত ‘ঐতিহাসিক’ সব ঝাড়বাতি, যার নীচে এক সময় বসত রাজা-রাজরার আসর। কত ইতিহাসের সাক্ষী সে সব জিনিস। এক-একটির দাম কয়েক লক্ষ টাকা।
দোকান পুনর্নির্মাণের ফলে জেজে হাসপাতালের কাছে একটি জায়গায় উঠে যেতে হয়েছে আসিফকে। সেখানেই গড়েছেন অস্থায়ী দোকান। আসিফের অভিযোগ, নতুন জায়গায় মার খেয়েছে ব্যবসা। তিনি জানালেন, চোর বাজারে দিনে যেখানে ১০০ জন খদ্দের আসতেন, এখানে মেরেকেট ১০ জন আসেন।
আসিফের কথায়, ‘‘বাধ্য হয়েই দোকানের জায়গা বদলেছি। ভেন্ডি বাজারের পুনর্নির্মাণ প্রকল্পটি বিশাল। দীর্ঘ দিন ধরে তা চলবে। তারই অংশ হল চোর বাজার। সে কারণে আমরাও জায়গা ছাড়তে বাধ্য হয়েছি।’’
সম্প্রতি শাহরুখের স্ত্রী গৌরী খান এবং ঋত্বিক রোশনের প্রাক্তন স্ত্রী সুজান খানের গৃহসজ্জা সংস্থার সঙ্গে কাজ শুরু করেছেন আসিফ। পোশাকশিল্পী সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়কে মুম্বইয়ের বিপণি সাজাতেও সাহায্য করেছেন।
সেই আসিফের কণ্ঠে এখন শুধুই আক্ষেপ। তিনি জানালেন, আগে লোকে চোর বাজারের সঙ্গে তাঁকে এক করে দেখতেন। ওই বাজারের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর সত্তা। এখন খদ্দেরদের নতুন করে চেনাতে হচ্ছে। বার বার বলতে হচ্ছে যে, তিনি আসলে সেই চোর বাজারেরই আসিফ।
দু’পাশে দোকান। মাঝে সরু গলি। সেই গলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই খোঁজ মিলত অতীত দিনের মণিমাণিক্য। তার পর দরদাম করে কিনতে হত সে সব। বড় দোকানের থেকে সস্তায় মিলত পছন্দের জিনিস। সেই গলি অতীত হতে চলেছে।
নির্মাণকারী সংস্থার তরফে জানা গিয়েছে, ভেন্ডি বাজারে উঠবে তিনতলা বাড়ি। সেখানেই সাজানো থাকবে প্রাচীন জিনিসের দোকান। গলি দিয়ে ঘুরে ঘুরে জিনিস কেনার পরিবর্তে লিফ্ট বা এসক্যালেটরে ওঠানামা করে খোঁজ চালাতে হবে পছন্দের জিনিসের। তাতেই আপত্তি বহু ক্রেতার।
আপত্তি বিক্রেতাদেরও। আসিফ জানিয়েছেন, শপিং মলে ঢুকে কেউ পুরনো ঘড়ি, শতাব্দীপ্রাচীন ছবির ফ্রেম, ঝাড়বাতি, আসবাব কিনতে চান না। সকলে ঝাঁ-চকচকে জিনিস খোঁজেন।
তবে এই অধিগ্রহণের উল্টো পিঠও রয়েছে। চোর বাজারে পুরুষানুক্রমে পাঁচটি দোকান রয়েছে মহম্মদ ফরমান মনসুরির। তাঁর আগের তিন প্রজন্ম চালিয়েছেন দোকানগুলি। মনসুরি জানান, এত কাল তাঁরা ছিলেন ভাড়াটে। এ বার নতুন মলে দোকানের লিখিত মালিকানা মিলবে। অতিরিক্ত জায়গা, গুদামঘরও পাবেন তাঁরা।
মনসুরি চোর বাজারের সংস্কার নিয়ে তাই অনেকটাই আশাবাদী। তাঁর মতোই ইতিবাচক ভাবছেন সংস্থার সিনিয়র ম্যানেজার মল্লিকার্জুন রাও। তিনি জানান, সময় বদলেছে। সেই সঙ্গে বদলেছে ক্রেতাদের রুচি-পছন্দ। নতুন ‘অবতার’-এ এলে ক্রেতারা খুশিই হবেন। অনেক সুবিধা পাবেন।
ক্রেতারা সুবিধা যে পাবেন, তা মিথ্যা নয়। তবে সেই পুরনো গলিঘুঁজিতে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ, পুরনোকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দ কি আর ফিরে পাবেন ক্রেতারা? এক কালে এই গলিতে ঘুরেই নিজের ছবি ‘৩৬ চৌরঙ্গি লেন’-এর জন্য ল্যাম্পশেড খুঁজে নিয়ে গিয়েছিলেন জেনিফার কপূর। সঙ্গে ছিলেন পরিচালক অপর্ণা সেন। এখন তিন তলা ঠান্ডা শপিং মলে লিফ্ট বেয়েই চালাতে হবে খোঁজ। আর না মিললে অনলাইন!