আমেরিকাকে জব্দ করতে এ বার সে দেশের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত পাঁচটি সংস্থাকে নিষিদ্ধ করার পথে হাঁটল চিন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে চিনের সেনা ‘পিপলস লিবারেশন আর্মি’-র সঙ্গে সংযোগ থাকা বেশ কিছু সংস্থাকে আগেই নিজেদের দেশে নিষিদ্ধ করেছিল আমেরিকা।
চিনের তরফে এ বার পাল্টা নিষিদ্ধ করা হল আমেরিকার পাঁচটি সংস্থাকে। তবে কোন ‘অপরাধে’ আমেরিকাকে এই শাস্তি দেওয়া হল, এখনও তা স্পষ্ট করেনি চিন। কেবল সে দেশের বিদেশ মন্ত্রকের তরফে বলা হয়েছে, আমেরিকার সিদ্ধান্তে চিনের সার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তা ছাড়া বেজিংয়ের সিদ্ধান্তে তাইওয়ানকে ঘিরে ওয়াশিংটন-বেজিং দ্বন্দ্বের ছায়াও পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে এখানেও বিশেষ কোনও নামের উল্লেখ করেনি প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের প্রশাসন।
চিনের বিদেশ মন্ত্রকের তরফে খানিক গোল গোল শব্দে বলা হয়েছে, চিনের সার্বভৌম অধিকার, নিরাপত্তা এবং ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার বিষয়টিকে সরকার গুরুত্ব দিয়ে দেখবে। একই সঙ্গে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে চিনের নাগরিক এবং সংস্থাগুলির গুরুত্বের উপরেও।
অনেকেই মনে করছেন, চিনের সংস্থাগুলি যাতে চিনের বাজারে অবাধে বাণিজ্য করতে পারে এবং আমেরিকার সংস্থাগুলি চিনের সংস্থাগুলির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে উঠে আসতে না পারে, তার জন্যই এই নিষেধাজ্ঞার পথে হেঁটেছে।
নিষিদ্ধ হওয়া পাঁচটি সংস্থার নামও প্রকাশ্যে এসেছে। তবে অনেকেই মনে করছেন চিনের এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা একেবারেই প্রতীকী। বাস্তবে এর কোনও মূল্য নেই।
তার কারণ এমনিতেই সরাসরি চিনের কোনও ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা সংস্থাকে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে না আমেরিকার প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত কোনও সংস্থা। তাই নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও এত দিন সংস্থাগুলির যে চিনে বিশেষ গুরুত্ব বা কদর ছিল, এমন নয়।
নিষেধাজ্ঞা জারির ফলে সংস্থাগুলির চিনে থাকা যাবতীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারবে বেজিং। একই সঙ্গে চিনের কোনও ব্যক্তি বা সংস্থা নিষিদ্ধ সংস্থাগুলির সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে আইনানুগ পদক্ষেপ করতে পারবে প্রশাসন।
তবে এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে তাইওয়ান-যোগও প্রকাশ্যে চলে এসেছে। গত ডিসেম্বরেই আমেরিকার জো বাইডেন সরকার তাইওয়ানকে প্রায় ৩০ কোটির ডলারের অস্ত্র ‘প্যাকেজ’ দেওয়ার বিষয়ে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে।
ওই প্যাকেজের মধ্যে রয়েছে তাইওয়ানের সেনাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া, অস্ত্রচালনার তালিম দেওয়া, এমনকি পুরনো অস্ত্র মেরামত করে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করা।
তাইওয়ানে আমেরিকার এই সক্রিয়তা ভাল চোখে নিচ্ছে না চিন। স্বশাসিত তাইওয়ানকে দীর্ঘ দিন ধরেই নিজেদের ভূখণ্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি করে এসেছে চিন। ১৯৭৯ সালে তাইওয়ানকে চিনের অংশ বলে স্বীকার করে নিলেও ভূখণ্ডটির ‘আত্মরক্ষার অধিকার’কে বরাবরই কূটনৈতিক এবং সামরিক সমর্থন জুগিয়েছে ওয়াশিংটন।
এই আবহেই আগামী সপ্তাহে তাইওয়ানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই নির্বাচনেও প্রধান যে বিষয়টি নিয়ে চর্চা চলছে, তা হল তাইওয়ান কি স্বাধিকার নিয়েই থাকবে, না কি আরও বেশি করে চিনের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।
আমেরিকা এবং চিন দুই দেশেরই নজর রয়েছে এই নির্বাচনের দিকে। তাইওয়ান প্রণালীকে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য যেমন সুরক্ষিত রাখতে চায় চিন, তেমনই এই প্রণালী দিয়ে নিজেদের এবং মিত্র দেশগুলির জাহাজ চলাচলকে বিপন্মুক্ত রাখতে চায় আমেরিকা।
এর মধ্যে আবার চিনা সেনার ক্ষেপণাস্ত্র বাহিনী থেকে দুর্নীতির অভিযোগে বেশ কয়েক জন শীর্ষ আধিকারিককে সাসপেন্ড করা হয়েছে। তাইওয়ানে সঙ্গে চলতি বছরেই আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তার আগে চিন-আমেরিকা সম্পর্ক কোন দিকে গড়াবে, সে দিকে নজর রয়েছে সকলের।
২০২২ সালের অগস্টে চিনের আপত্তি খারিজ করে আমেরিকার কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউস অফ রিপ্রেজ়েনটেটিভসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের পরেই নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়।
সে সময় ধারাবাহিক ভাবে তাইওয়ানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করতে শুরু করে চিনা যুদ্ধবিমান। চিন-তাইওয়ান সঙ্কটের আবহে সে সময় আমেরিকার সপ্তম নৌবহরের অন্তর্ভুক্ত কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ তাইওয়ান প্রণালীতে ঢুকেছিল। বর্তমানে সেখানে মোটের উপর স্থিতাবস্থা থাকলেও চিন যে ভাবে আমেরিকার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করছে, তাতে নতুন করে উত্তেজনা ছড়ানোর আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ।