চিনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কোনও দিনই খুব একটু ‘সু’ ছিল না। বরং ভারতের সঙ্গে যে ক’টি পড়শি দেশের বারো মাস চাপা উত্তেজনা লেগে থাকে, চিন তার মধ্যে অন্যতম।
চিন এবং ভারতের পারস্পরিক সম্পর্কের প্রভাব মাঝেমাঝেই পড়তে দেখা যায় দুই দেশের সীমান্তে। কাঁটাতারকে কেন্দ্র করে বার বার উত্তাপ ছড়ায় লাদাখ কিংবা অরুণাচল প্রদেশে।
কিন্তু কূটনৈতিক সম্পর্ক যতই তিক্ত হোক না কেন, চিন এবং ভারতের মধ্যে বাণিজ্যে কিন্তু তার কোনও প্রভাব পড়ে না। দুই দেশের বাণিজ্যিক লেনদেন কূটনীতির ‘মায়াজাল’ থেকে বহু দূরে।
তবে সম্প্রতি, এই বাণিজ্যে টান পড়েছে। বহু বছর পর চিনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চিন-ভারত বাণিজ্য ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।
চলতি বছরের প্রথমার্ধেই চিনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক হ্রাস পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেখা গিয়েছে, দুই দেশের বাণিজ্যিক লেনদেন এই ছ’মাসে ০.৯ শতাংশ কমেছে।
গত বৃহস্পতিবার চিনের শুল্ক দফতর যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা গিয়েছে, চলতি বছরের প্রথম ছ’মাসে চিন থেকে ভারতে রফতানি করা হয়েছে মোট ৫৬৫৩ কোটি ডলারের পণ্য।
কিন্তু গত বছর এই সময়ের মধ্যে চিন থেকে ভারতে ৫৭৫১ কোটি ডলার অর্থমূল্যের পণ্য রফতানি করা হয়েছিল। ফলে ০.৯ শতাংশ রফতানি এ বছর কমেছে।
ওই একই পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরে এখনও পর্যন্ত ভারত থেকে চিনে রফতানি করা হয়েছে মোট ৯৪৯ কোটি ডলারের পণ্য। এটিও গত বছরের চেয়ে কম।
২০২২ সালের প্রথমার্ধে মোট ৯৫৭ কোটি ডলারের পণ্য ভারত থেকে চিনে গিয়েছিল। অর্থাৎ, আমদানি এবং রফতানি, উভয় ক্ষেত্রেই লেনদেন অনেকটা কমেছে।
ভারত এবং চিনের বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ২০২২ সাল ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওই বছর দুই দেশের বাণিজ্য বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। বাণিজ্যিক লেনদেন ছিল নজিরবিহীন।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২২ সালে চিন এবং ভারতের মধ্যে মোট ১৩,৫৯৮ কোটি টাকার বাণিজ্যিক আদান প্রদান হয়। আমদানি এবং রফতানি মিলিয়ে এই পরিসংখ্যান অতীতের যাবতীয় নজির ভেঙে দিয়েছিল।
এর আগে এক বছরে চিন এবং ভারতের সর্বোচ্চ বাণিজ্যিক লেনদেন ছিল ১২,৫০০ কোটি টাকার। ২০২২ সালে তা ৮.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই বাণিজ্যের গ্রাফ আবার নিম্নমুখী।
ভারত-চিন বাণিজ্যের এই দুরবস্থা কেন? কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রভাব কি বাণিজ্যেও পড়তে শুরু করল? বাস্তবে কিন্তু এর নেপথ্যে লুকিয়ে অন্য অঙ্ক।
শুধু ভারত নয়, আসলে সার্বিক ভাবেই চিনের বাণিজ্য হোঁচট খাচ্ছে। সব ক্ষেত্রেই আমদানি এবং রফতানিতে এ বছর তুলনামূলক পিছিয়ে পড়েছে বেজিং।
চলতি বছরের প্রথমার্ধে চিনের মোট বাণিজ্য ৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। রফতানি কমেছে ৩.২ শতাংশ এবং আমদানি কমেছে ৬.৭ শতাংশ।
কোভিড পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দার রেশ এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি চিন। তারই প্রভাব পড়ছে দেশটির বাণিজ্যিক পরিকাঠামোয়। বিদেশের সঙ্গে লেনদেনের পরিমাণ সেই কারণে হ্রাস পেয়েছে।
কোভিড পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে চিনে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে গিয়েছে। সেই মূল্যবৃদ্ধি সামাল দিতে চিনের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক পদক্ষেপ করেছে।
বিদেশি ক্রেতাদের জন্য সুদের হার বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছে চিনের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। যে কারণে বিদেশের বাজারে তাদের পণ্যের চাহিদা কিছুটা কমেছে।
এই পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের বৃদ্ধির দিকে তাকিয়ে আছে চিন। বিদেশে তাদের বাণিজ্য ধাক্কা খাচ্ছে। দেশের অন্দরে বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি হলে অর্থনীতির ভারসাম্য বজায় থাকবে।
চিনের অন্দরেও যদি বাণিজ্য একই ভাবে ধাক্কা খায়, তবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসাবে মুখ অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়তে পারে শি জিনপিংয়ের দেশ।