মলদ্বীপে ক্ষমতায় এসেছেন মহম্মদ মুইজ়ু। সম্প্রতি দেশের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। কিন্তু মুইজ়ুর এই জয়ে খুশি হতে পারছে না ভারত। বরং মলদ্বীপের রাজনীতির এই পালাবদলে চিন্তার মেঘ ঘনিয়েছে নয়াদিল্লির আকাশে।
ভারতের একেবারে দক্ষিণ-পশ্চিমে লক্ষদ্বীপেরও নীচে ভারত মহাসাগরের উপর ছোট্ট দেশ মলদ্বীপ। ঘুরতে যাওয়ার বিলাসবহুল ঠিকানা হিসেবে পরিচিত এই দ্বীপরাষ্ট্র। বলিউড তারকাদের ছুটি কাটানোর অন্যতম পছন্দের গন্তব্য এটাই।
ভারতের দক্ষিণ দিকের পড়শি দেশগুলির মধ্যে মলদ্বীপ গুরুত্বপূর্ণ। এই দেশের রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে ভারতের স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে। তাই মলদ্বীপে রাষ্ট্রপ্রধানের কুর্সিতে কে বসলেন, তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে থাকে নয়াদিল্লিও।
গত ৯ সেপ্টেম্বর মলদ্বীপের নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় এসেছেন মুইজ়ু। তাঁকে নিয়ে ভারতের আপত্তির কারণ রয়েছে। মুইজ়ু চিনপন্থী হিসেবে পরিচিত। তাঁর প্রেসিডেন্ট হওয়ার নেপথ্যেও চিনের হাত রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এর আগে মলদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইব্রাহিম সোলি। তিনি ছিলেন ভারতঘেঁষা। ফলে উত্তর-পশ্চিম ভারত মহাসাগরের উপর এই পড়শি দেশটিকে নিয়ে ভারত একপ্রকার নিশ্চিন্ত ছিল।
মুইজ়ু প্রেসিডেন্ট হওয়ায় মলদ্বীপ নিয়ে ভারতকে বাড়তি চিন্তাভাবনা করতে হবে। কারণ তিনি চিনের কথায় চলতে পারেন। তাঁর অনেক সিদ্ধান্তই যেতে পারে ভারতের বিরুদ্ধে। দক্ষিণের সীমান্তে নজরদারিও জোরদার করতে হবে নয়াদিল্লিকে।
মলদ্বীপের রাজধানী মালের মেয়র ছিলেন মুইজ়ু। দেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ্ ইয়ামিনের ঘনিষ্ঠ বলেও পরিচিত তিনি। ইয়ামিন চিনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভারতে নানা সমস্যায় ফেলার চেষ্টা করেছিলেন বলে অভিযোগ।
ভারতঘেঁষা সোলি কেন এ বার আর ভোটে জিততে পারলেন না? নেপথ্যে উঠে এসেছে অনেকগুলি কারণ। সোলি দেশের প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে পারেননি বলে অভিযোগ। তাঁর আমলে সরকারের অন্দরে দুর্নীতি বেড়ে গিয়েছিল। যা সাধারণ মানুষ ভাল চোখে দেখেনি।
সোলির বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ভারত নির্ভরশীলতার অভিযোগ আনেন মুইজ়ু। তাঁর অভিযোগ, সোলি নিজে কোনও সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন না। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ভারতের পরামর্শ নেন। এতে মলদ্বীপের সার্বভৌমত্বে আঘাত লাগে।
সোলি মলদ্বীপে ক্ষমতায় এসেছিলেন ২০১৮ সালে। তার ঠিক পরপরই মলদ্বীপে উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কাজের জন্য ১৪০ কোটি ডলার অর্থসাহায্য ঘোষণা করে ভারত। এতে সোলি সরকারের ভারত-নির্ভরশীলতা আরও বেড়ে যায়।
মলদ্বীপে মুইজ়ু সরকার গঠনের পর ভারতের সঙ্গে এই দ্বীপরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তাজনিত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ব্যাহত হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে ভারতের সাহায্য নেওয়া বন্ধ করে দিতে পারে মলদ্বীপ।
যদিও ক্ষমতায় আসার পর মুইজ়ু জানিয়েছেন, মলদ্বীপের হিতার্থে আগের সরকারের কোনও উন্নয়নমূলক প্রকল্প তিনি স্তব্ধ করবেন না। মলদ্বীপের রাজনীতিতে চিন কলকাঠি নাড়তে শুরু করলে সেই কথা তিনি রাখতে পারবেন কি না, সেটাই দেখার।
মলদ্বীপের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট চিনঘনিষ্ঠ ইয়েমেন ক্ষমতায় আসার পর তাদের দেশের আকাশ থেকে ভারতীয় নৌসেনার কপ্টার সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। নৌসেনা আধিকারিকদেরও চলে যেতে বলেছিলেন। নতুন প্রেসিডেন্ট মুইজ়ু সেই ইয়েমেনের ঘনিষ্ঠ। তিনিও সেই পদাঙ্ক তিনি অনুসরণ করেন।
ভারতের উত্তরের সীমান্তে রয়েছে চিন। উত্তর-পশ্চিমের পাকিস্তান সেই চিনের অনুগামী। ফলে উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিম থেকে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চিনের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ভারতের দক্ষিণের সীমানাতেও হাত বাড়িয়েছে তারা।
শ্রীলঙ্কায় অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে চিন। ইতিমধ্যে দক্ষিণের এই দ্বীপরাষ্ট্রের অন্দরে তারা বেশ কিছুটা প্রভাব বিস্তার করেও ফেলেছে। এ বার দক্ষিণ-পশ্চিমের মলদ্বীপও চলে যাচ্ছে জিনপিংয়ের হাতের মুঠোয়।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, মলদ্বীপে চিনপন্থী সরকার ক্ষমতায় আসায় দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তের নিরাপত্তা নিয়ে এ বার নতুন করে ভাবার সময় এসেছে ভারতের। নয়তো, উত্তরে নয়াদিল্লি যখন পাকিস্তানকে নিয়ে ব্যস্ত, সেই ফাঁকে চিন কাজে লাগাতে পারে ভারত মহাসাগরকে।
ভারতকে চার দিক থেকে ঘিরে ফেলে চাপে রাখার কৌশল চিনের নতুন নয়। এ বিষয়ে ভারতীয় কূটনীতিকেরা অবগত। তাই মলদ্বীপের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ভেবেচিন্তে পা ফেলতে হবে তাঁদের। সেই পরামর্শই দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা।