হাজার হাজার বসন্ত পেরিয়েও দিব্যি মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ‘প্রপিতামহ’ (‘গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার’)। ওই নামেই পরিচিত সে। চিলির ঘন অরণ্যে ডালপালা মেলে থাকা ৫ হাজারেরও বেশি বছরের এই বিশালাকায় বৃক্ষটিই নাকি বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো। সরকারি ভাবে সে তকমা দেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।
মিশরের দক্ষিণ কায়রো শহর থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার দূরে সাকারা এলাকায় সম্প্রতি ৪,৩০০ বছরের পুরনো একটি মমির খোঁজ মিলেছে। প্রত্নতত্ত্ববিদদের একাংশের মতে, সেটিই বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো মমি। যদিও এই দাবি নিয়ে দ্বিমত রয়েছে।
অঙ্কের হিসাবে ওই মমির বয়সকেও ছাপিয়ে গিয়েছে ‘গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার’। সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া তার একটি শিকড়ের ব্যাসার্ধই ১৩ ফুটের। আর দৈর্ঘ্যে তা প্রায় ৯২ ফুট।
এর আগে বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো বৃক্ষের তকমা ছিল ‘মেথুসেলা’র দখলে। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার ওই গ্রেট বেসিন বিস্লকোন পাইন গাছটি ৪,৮৫০ বছরের পুরনো।
এত বছর ধরে কী ভাবে বিরূপ পরিবেশের ঝড়ঝাপ্টা সামলে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখল ‘প্রপিতামহ’, তা জানতে বৃক্ষটির থেকে তার অংশ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করা হচ্ছে।
দক্ষিণ চিলির অরণ্যের এই গাছটির প্রকৃত বয়স জানতে এর নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষায় নেমেছেন একদল বিজ্ঞানী। তার মধ্যে রয়েছেন আর্জেন্টিনার অস্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তোনিয়ো লারা। চিলির সেন্টার ফর ক্লাইমেট সায়েন্স অ্যান্ড রেজ়িলিয়েন্সের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন তিনি।
সংবাদমাধ্যমের লারা বলেন, ‘‘এই গাছটি উত্তরজীবী। অন্য কোনও গাছের এত বছর বেঁচে থাকার সুযোগ হয়নি।’’ চিলির রাজধানী সান্তিয়াগো থেকে প্রায় ৮০০ কিলোমিটার দক্ষিণে লস রিওয় অঞ্চলের অরণ্যে একটি খাদের ধারে রয়েছে গাছটি।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, সরলবর্গীয় চিরহরিৎ এই গাছটি আসলে ফিৎরোজোয়া কাপ্রেসোদেস প্রকৃতির। লাতিন আমেরিকায় এটি স্থানীয় গাছ হিসাবে পরিচিত।
কিছু দিন আগে পর্যন্ত ঘণ্টাখানেক হেঁটে অরণ্যের গভীর গিয়ে ‘প্রপিতামহের’ সঙ্গে ছবি তুলতে যেতেন পর্যটকেরা। তবে ‘প্রপিতামহের’ বয়স নিয়ে হইচই শুরু হতেই এর পাহারায় রেঞ্জারের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ১৯৭২ সালে চিলির এই অরণ্যে ঘোরাফেরা করার সময় এই গাছটিকে খুঁজে পেয়েছিলেন ওয়ার্ডেন আনিবাল হেনরিকুয়েজ়। তার পর থেকে এর সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন বিজ্ঞানীরা।
‘প্রপিতাহামহের’ দেখা পাওয়ার প্রায় ষোলো বছর পর হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান হেনরিকুয়েজ়। তবে আমৃত্যু এটির কথা নাকি গোপন রাখতে চেয়েছিলেন তিনি।
গাছটির কথা গোপন রাখার কারণ কী? হেনরিকুয়েজ়ের মেয়ে ন্যান্সি সংবাদমাধ্যমের কাছে বলেন, ‘‘এই গাছটি যে অত্যন্ত মূল্যবান, তা বুঝতে পেরেছিলেন বাবা। তাই পর্যটক বা আমজনতার থেকে এর অস্তিত্ব গোপন রেখেছিলেন।’’
হেনরিকুয়েজ়ের ভাইপো জোনাথন বারিচিভিচ এই বিশাল গাছের নীচেই খেলাধুলো করে বড় হয়েছেন। এর উপর যে বিশেষজ্ঞ দলটি পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছে, সে দলের সদস্য তিনি।
২০২০ সালে ‘প্রপিতামহের’ কেন্দ্রস্থল থেকে নমুনা সংগ্রহে নেমেছিলেন বারিচিভিচ এবং লারা। তাঁদের সঙ্গে ছিল বিশেষজ্ঞ দল। কেন্দ্রস্থল পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি তাঁরা। তবে গাছটির নমুনা পরীক্ষার পর বিশেষজ্ঞদের দাবি ছিল, সেটি প্রায় আড়াই হাজার বছর পুরনো।
বারিচিভিচের মতে, ‘প্রপিতামহের’ সম্ভাব্য পথের ৮০ শতাংশ দেখে মনে হচ্ছে, এটি ৫ হাজার বছরের পুরনো হবে। শীঘ্রই এর প্রকৃত বয়স নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার ফলাফল জানা যাবে। সে জন্য ‘ডেনড্রোক্রোনোলজি’ নামে এক পরীক্ষার সাহায্য নেওয়া হচ্ছে।
বারিচিভিচ বলেন, ‘‘এ ধরনের প্রাচীন গাছের বিশেষ ইতিহাস রয়েছে। কারণ, এরা প্রতিরোধের প্রতীক। কী ভাবে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়, তা জানে এরা। এ ধরনের গাছ আসলে প্রকৃতির সেরা অ্যাথলিট।’’
অস্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেনড্রোক্রোনোলজি অ্যান্ড গ্লোবাল চেঞ্জ ল্যাবরেটরির সরকারি গবেষক কারমেন গ্লোরিয়া রদ্রিগেজ় জানিয়েছেন, দাবানল থেকে শুরু করে চিলিতে ১৯৬০ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্প— সবেরই সাক্ষী থেকেছে এই বৃদ্ধ গাছ।
সংবাদমাধ্যমে কারমেন বলেন, ‘‘এই গাছগুলি আসলে খোলা বইয়ের মতো। আর আমরা পড়ুয়ার মতো গাছটির প্রতিটি রিং নিয়ে পড়াশোনা করছি।’’
বারিচিভিচের মতে, ‘‘এই ধরনের গাছের অস্তিত্ব মুছে গেলে জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠিও হারিয়ে যাবে। যার মাধ্যমে জানা যায়, কী ভাবে পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়!’’