বয়স ৬০ বছর হলেও তাঁকে দেখে মনে হত ৮৫। এক কালে বক্সিং রিংয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। হিংসাত্মক কাণ্ডকারখানায় শহরের ত্রাসও হয়ে উঠেছিলেন। এমনকি, ঘুষি মেরে হাঙরদের তাড়িয়েছেন বলেও তাঁর দাবি। তবে দু’দশকের বেশি জেলে কাটিয়ে, মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান করে, বাত আর ডায়াবিটিসে ভুগে, শেষংবয়সে এতটাই দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন যে বিয়ারের ক্যানও খুলতে পারতেন না ইংল্যান্ডের প্রয়াত বক্সার পল সাইক্স।
পলের জীবনে চড়াই-উৎরাই কম ছিল না। তাঁর ঘটনাবহুল জীবনের নানা মশলা নিয়ে একাধিক বই লেখা হয়েছে। তৈরি হয়েছে টেলিভিশন সিরিজ়। এমনকি, একটি সিনেমাও তৈরি হচ্ছে।
ইংল্যান্ডের ওয়েকফিল্ডের বাসিন্দা পল আদতে পেশাদার হেভিওয়েট বক্সার ছিলেন। তবে তাঁর যৌবনের অধিকাংশ সময় কেটেছিল জেলবন্দি হয়ে। সত্তর, আশি পেরিয়ে নব্বইয়ের দশকে সেখানেও যথেষ্ট কুখ্যাতি কুড়িয়েছিলেন পল।
পলের জন্ম ১৯৫৬ সালের ১৫ মে। ৭ বছর থেকেই স্থানীয় এক ক্লাবে বক্সিংয়ের খুঁটিনাটি শিখতে শুরু করেছিলেন ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ারের ওয়েকফিল্ডের বাসিন্দা বেটি বার্লো এবং ওয়াল্টার সাইক্সের সেই ছেলে। কিশোর বয়সেই বক্সিংয়ের পাশাপাশি অপরাধের জগতেও ঢুকে পড়েছিলেন তিনি।
আইনের চোখে পলের অপরাধী হওয়া মাত্র ১৭ বছর বয়সে। ওই বয়সেই জেল হয়েছিল পলের। যদিও ১৯৭১ সালে তাঁর কোন অপরাধে ওই শাস্তি হয়েছিল, সে সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়নি।
ছোটবেলা থেকেই বক্সিংকে পেশা হিসাবে বেছে নিতে চেয়েছিলেন পল। তবে কম বয়স থেকেই মদ্যপানের নেশা পেয়ে বসেছিল তাঁকে। তাতে তাঁর কম ক্ষতি হয়নি।
১৬ বছর বয়সে জার্মানির একটি প্রতিযোগিতার অংশগ্রহণ করতে গিয়েছিলেন পল। তবে লড়াইয়ের আগের রাতে সেখানকার একটি পানশালায় গিয়ে এতটাই সুরাপান করেছিলেন যে, তাঁকে টেনে বার করে গাড়িতে তুলতে হয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবেই পরের দিন রিংয়ে গোহারা হেরে বাড়ি ফিরেছিলেন।
মদ্যপানের পাশাপাশি নিজের এলাকার মারপিট, ঝামেলা করেও কুখ্যাতি কামিয়েছিলেন পল। তা নিয়ে বার বার থানাপুলিশও হত। তবে বক্সার হিসাবে তাঁর প্রতিভা নিয়ে প্রশ্ন ছিল না। বিশালদেহী হওয়া সত্ত্বেও রিংয়ে দ্রুত নড়াচড়ায় পটু ছিলেন পল।
লিভারপুলের একটি জেলে ৫ বছর বন্দিদশায় থাকাকালীন আবার বক্সিং রিংয়ে নামার সুযোগ পেয়েছিলেন পল। বুটল এলাকায় স্থানীয় এক ম্যাজিস্ট্রেটের মেপল লিফ অ্যামেচার বক্সিং ক্লাবে যোগদানের অনুমতিও পেয়ে যান।
১৯৭৩ সালে ওই ক্লাবের হয়ে বিভিন্ন দেশে প্রতিযোগিতায় নামার জন্য বক্সিং লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল পলকে। সে সময় ইংল্যান্ডের অপেশাদার বক্সিংয়ের ভাবী হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হিসাবে তাঁর নাম ভেসে বেড়াত। তবে ওই বছর প্রতিযোগিতার সেমিফাইনালে ভবিষ্যতের বিজেতা গারফিল্ড ম্যাকইয়ানের কাছে হেরে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি।
’৭৩-এ জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ইংল্যান্ডের ব্ল্যাকপুল সমুদ্রতটে লাইফগার্ড হিসাবে কাজ নেন পল। সেই সঙ্গে বক্সিংয়েও মন দেন তিনি। তবে তাঁর বক্সিং কেরিয়ারে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল অতিরিক্ত মদ্যপানের ঝোঁক, মানসিক সমস্যা এবং ছোটোখাটো ডাকাতি, মারপিটের মতো অপরাধ।
মদ্যপান করে ঝামেলা করা বা অপরাধমূলক সমাজবিরোধী আচরণের জন্য ওয়েকফিল্ড সিটি সেন্টারে পলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তবে ৩০ বছর বয়সে নতুন করে শুরু করেছিলেন পল। ওই বয়সেই পেশাদার বক্সার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি।
পেশাদার বক্সার হিসাবে পলের প্রথম লড়াই ছিল ’৭৮-এ। তবে ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার ১০১ কিলো ওজনধারী পলের জবরদস্ত ঘুষির ঘায়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে নিজের টুল ছেড়ে উঠতেই পারেননি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী।
যদিও বছর দুয়েকের মধ্যেই পলের বক্সিং কেরিয়ার শেষ হয়ে গিয়েছিল। ওই স্বল্প সময়েই ১০টির মধ্যে ৬টি জয় পেয়েছিলেন পল। তবে ৩টি লড়াইয়ে হার এবং ১টি ড্র করেছিলেন।
রিংয়ের প্রতিদ্বন্দ্বীদের মতোই এক ঘুষিতে হাঙর তাড়িয়েছিলেন বলেও একটি তথ্যচিত্রে দাবি করেছিলেন পল। সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়া মধ্যে জহর প্রণালী সাঁতরে পারাপার করার সময় নাকি হাঙরের ঝাঁক তেড়ে এসেছিল তাঁর দিকে। তাঁর দাবি, হাঙরদের কানে ঘুষি মেরে তাদের তাড়িয়েছিলেন পল।
বক্সিং কেরিয়ারে গ্রহণ লাগলেও অপরাধ জগতে নাম ছড়াতে থাকে পলের। তাঁর দাঙ্গাবাজ, হিংসাত্মক মূর্তি দেখেছে ইংল্যান্ডের লিডস লিভারপুল, ব্ল্যাকপুল, হাল এবং রটারহ্যাম এলাকা। স্থানীয় বাসিন্দা ছাড়াও জেল এবং পুলিশ আধিকারিককেও পিটিয়েছেন। ২১ বছরে মোট ১৮টি কারাগারে বন্দিজীবন কাটিয়েছেন পল।
জেলে গিয়েও পলের উগ্র ভাবমূর্তির বদল ঘটেনি। উল্টে ইংল্যান্ডের কুখ্যাত জেলবন্দিদের তালিকায় ঢুকে পড়েছিলেন তিনি। একটি সাক্ষাৎকারে পলের উক্তি ছিল, ‘‘হিংসায় আমার মতো দক্ষতা আর কেউ দেখাতে পারেননি। সারা জীবন তা-ই তো করেছি।’’
জীবনের বেশির ভাগ সময় দাপট দেখালেও শেষ জীবনে বেশি বেকায়দায় পড়েছিলেন পল। পলের জীবনের নানা দিক নিয়ে গবেষণা করেছেন জেমি বয়েল। পলকে নিয়ে ৩টি বইও লিখেছেন তিনি। জেমি জানিয়েছেন, শেষ জীবনে যেন নিজের ছায়ায় পরিণত হয়েছিলেন পল। ২০০৭ সালে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ওয়েকফিল্ডের টমাস পার্কে তাঁকে দগ্ধ অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। ঘুমন্ত পলের গায়ে দাহ্য তরল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল একটি গ্যাঙের লোকজন।
দীর্ঘ দিন জেলবন্দি পলের শরীরে বাসা বেঁধেছিল বাত এবং ডায়াবিটিস। অতিরিক্ত মদ্যপানে যকৃৎ বিকল হয়ে গিয়েছিল। নিউমোনিয়ায়ও ভুগছিলেন তিনি। ২০০৭ সালের মার্চে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল তাঁকে। তবে ওই বছরই হাসপাতালে মারা যান পল।
জেলবন্দি অবস্থায় নিজের জীবন নিয়ে ‘সুইট অ্যাগোনি’ নামে একটি বহুল প্রশংসিত বই লিখেছিলেন পল। ২০১৯ সালে তাঁর জীবন নিয়ে একটি সিনেমা তৈরিতে হাত দিয়েছিলেন ব্রিটিশ নির্মাতা সংস্থা ‘ওয়েস্টার্ন এ়জ় পিকচার্স’। তাতে পলের ভূমিকায় নামতে পারেন ‘এমারেল্ড’ সিরিজ়ের অভিনেতা মাইকেল পার। তবে অতিমারি পর্বে তার নির্মাণ ব্যাহত হয়েছে।
অপরাধের জন্য দুর্নামের ভাগীদার হলেও পলের ভক্ত ছিলেন ইংল্যান্ডের আর এক কুখ্যাত জেলবন্দি চার্লস ব্রনসন। ‘লেজেন্ড’ নামে একটি বইয়ে পলের সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য ছিল, ‘‘পল ছিলেন ইয়র্কশায়ারের কুখ্যাত লোক, কড়া ধাতের তবে সব অর্থেই লড়াকু।’’