পুরুষ হওয়ার পরেও পুরুষদের প্রতি অনুভূতি কেন তৈরি হচ্ছে? তবে কি তিনি সমকামী? ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন যে, পুরুষালী চেহারা হলেও তিনি নারীমন নিয়ে জন্মেছেন। তিনি আর কেউ নন, ভারতের প্রথম রূপান্তরকামী পোশাকশিল্পী স্বপ্নিল শিন্ডে।
করিনা কপূর খান, ক্যাটরিনা কইফ, দীপিকা পাড়ুকোন, অদিতি রাও হায়দারির মতো অভিনেত্র্রীর সঙ্গে কাজ করেছেন স্বপ্নিল। বলিপাড়ায় ভালই নামডাক রয়েছে তাঁর।
সমাজমাধ্যমেও স্বপ্নিলের অনুরাগীমহল তৈরি হয়েছে। ইনস্টাগ্রামে ইতিমধ্যেই তাঁর অনুরাগীর সংখ্যা আড়াই লক্ষের গণ্ডি পেরিয়ে গিয়েছে।
‘বেশরম রং’— ‘পাঠান’ ছবির যে গানের দৃশ্যে দীপিকার পোশাক নিয়ে এত বিতর্ক, সেই গানে নায়িকার জন্য পোশাক বুনেছেন স্বপ্নিল। তবে গেরুয়া বিকিনি নয়। গানের শুরুতে অভিনেত্রীকে যে ক্রপ টপ এবং চেনমেল স্কার্ট পরে দেখা গিয়েছে, সেই পোশাকটিই ডিজ়াইন করেছেন ৪১ বছর বয়সি স্বপ্নিল।
১৯৮১ সালে মুম্বইয়ের দাদরে জন্ম স্বপ্নিলের। এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা তাঁর। মুম্বইয়ে স্কুল এবং কলেজের পড়াশোনা শেষ করেছেন তিনি। মহিলাদের সাজপোশাকের প্রতি ছোট থেকেই আগ্রহ ছিল তাঁর। তাই ফ্যাশন ডিজ়াইনিং নিয়ে পড়াশোনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি।
ছেলে হয়েও মেয়েদের মতো ব্যবহার করতেন বলে স্বপ্নিলের স্কুলের সহপাঠীরা কুমন্তব্য করতেন। সহপাঠীদের ভয়ে স্কুলের গির্জার এক কোনায় লুকিয়ে থাকতেন তিনি।
স্বপ্নিলের যখন সবে বছর কুড়ি, তখন তিনি পুরুষদের প্রতি প্রথম আকর্ষণ অনুভব করেন। লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে দোটানায় ভুগতেন তিনি। নিজেকে সমকামী ভেবে নিয়েছিলেন। বহু চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলার পর, থেরাপির পর তিনি অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন। এক পুরনো সাক্ষাৎকারে এমনটাই জানান তিনি।
স্বপ্নিল বলেন, ‘‘আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমার মধ্যে কোনও সমস্যা রয়েছে। আমার বন্ধুরা জানত না যে আমি বন্ধ দরজার পিছনে অন্য ধরনের পোশাক পরতাম, হিল জুতো পরতাম, এমনকি মেকআপও করতাম। আমি দু’রকম পরিচয়ে বাঁচতাম।’’
স্বপ্নিল তাঁর মনের কথা ভাগ করে সাক্ষাৎকারে জানান যে, মাঝেমধ্যে তাঁর মনে হত যে তিনি মন থেকে নারী হয়েও প্রকাশ্যে নিজেকে পুরুষের সাজপোশাক দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করছেন।
মানসিক দিক দিয়ে ভাঙতে শুরু করেছিলেন স্বপ্নিল। প্যানিক অ্যাটাকের জন্য ওষুধও খাওয়া শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু তিনি নারী-পুরুষের এই অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে চাইছিলেন না। জীবনে শান্তি চাইছিলেন তিনি। তাই স্বপ্নিল রূপান্তরকরণের সিদ্ধান্ত নেন।
প্রক্রিয়া শুরু করার আগে স্বপ্নিলকে অনেকেই নানা কথা বলেছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘লোকজন আমায় ভয় দেখাতেন। ওষুধপত্রের ফলে শরীরে অন্যান্য উপসর্গ দেখা দিতে পারে বলে আমায় অনেকে বারণও করেছিলেন।’’ কিন্তু সকলের কথা উপেক্ষা করে তিনি ২০২০ সালে অস্ত্রোপচার করান।
তার পর নিজের নামও পরিবর্তন করে স্বপ্নিল হয়ে যান সায়শা। কিন্তু সায়শা নামটি পছন্দ ছিল না তাঁর। তিনি জানান যে, নিজের নাম বদলে মস্তানি রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর পরিবারের সদস্যরা সেই নামে আপত্তি জানান।
সায়শা ওরফে স্বপ্নিল বলেন, ‘‘চারটি নামের মধ্যেই যে কোনও একটি নাম পছন্দ করতে হত আমায়। চারটির মধ্যে মস্তানি নাম পছন্দ হয়। কিন্তু বাড়ির কারও পছন্দ হয়নি নামটা। তাঁরা সায়শা নামটি রাখতে বলেন। সায়শা শব্দের মানে ‘অর্থবহ জীবন’। আমি নিজেও আমার জীবনকে অর্থবহ তৈরি করতে চেয়েছিলাম। তাই শেষ পর্যন্ত সায়শা নামটিই রাখলাম।’’
মুম্বইয়ে ফ্যাশন ডিজ়াইনিং নিয়ে পড়াশোনার পর ইটালিতে এই বিষয়ে ছয় মাসের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে গিয়েছিলেন স্বপ্নিল। তখনও তিনি সায়শা হননি।
ইটালি থেকে ফিরে আসার পর স্বপ্নিল মুম্বইয়ের একটি ফ্যাশন স্টোরে সেলসবয়ের কাজ শুরু করেন। কিছু দিন কাজ করার পর তাঁর পদোন্নতি হয়। পরে নিজস্ব একটি সংস্থা খুলে ফেলেন তিনি।
২০০৭ সালে নিজের ফ্যাশন স্টোর খোলার পর তার প্রচারও শুরু করলেন স্বপ্নিল। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে নামডাক হয়ে যায় তাঁর। বলিপাড়ার জনপ্রিয় নায়িকাদের পোশাকও তৈরি করেন তিনি।
‘ফ্যাশন’, ‘গুজ়ারিশ’ এবং ‘লক্ষ্মী’র মতো বহু হিন্দি ছবিতে পোশাকশিল্পী হিসাবে কাজ করেছেন সায়শা। আমেরিকার একটি রিয়্যালিটি শোয়ে প্রতিযোগী হিসাবে অংশগ্রহণ করেন তিনি।
কঙ্গনা রানাউত সঞ্চালিত ‘লক আপ’ শোয়েও অতিথি হিসাবে এসেছিলেন সায়শা। ২০২১ সালে এক সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার চুড়ান্ত পর্বে হারনাজ় কউর সন্ধু যে গাউন পরেছিলেন, তা ডিজ়াইন করেছিলেন সায়শা।
ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির পাশাপাশি ব্যবসাতেও হাত পাকিয়ে ফেলেছেন সায়শা। মুম্বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় রেস্তরাঁও খুলেছেন তিনি।