বলিউড মানেই খান, কপূরদের একচ্ছত্র আধিপত্য। লোকে বলে, ফিল্মি পরিবারের সদস্য না হলে নাকি বলিপাড়ায় পা রাখা দুঃসাধ্য। এ নিয়ে তর্কবিতর্কও নেহাত কম নয়। আবার গায়ে তারকা সন্তানের তকমা না থাকা সত্ত্বেও বলি দুনিয়ায় রাজ করেছেন, এমন উদাহরণও রয়েছে। আবার এমন অনেক তারকা সন্তানই রয়েছেন, যাঁদের সহজেই হাতেখড়ি হয়েছিল বলিপাড়ায়। কিন্তু তাঁরা লম্বা রেসের ঘোড়া হতে পারেননি। ‘বহিরাগত’ অর্থাৎ যাঁদের সঙ্গে চলচ্চিত্র দুনিয়ার কোনও সংযোগই নেই, সেই তাঁরা নাকি বলিউডে পা রাখতে হিমশিম খান। আর এ জন্য নাকি ‘নেপোটিজম’ বা ‘ফেভারিটজম’ (স্বজনপোষণ) দায়ী।
বলিউডে একটা সুযোগ পাওয়া নিয়ে এই ধরনের তর্কবিতর্ক রয়েছে এবং থাকবেও। তবে এর মধ্যেই এমন অনেক তারকা দর্শকমহলে পরিচিত হয়েছেন, যাঁদের দেখে মনে হতে পারে তাঁরা বলিউডের ‘বহিরাগত’ শিবিরের সদস্য। অথচ আদতে তাঁদের সঙ্গে বলিপাড়ার কোনও না কোনও সংযোগ ঠিক রয়েইছে।
বি-টাউনের হাল আমলের উজ্জ্বল মুখ ভিকি কৌশল। ২০১৫ সালে ‘মাসান’ ছবির হাত ধরে পর্দার নায়ক হিসাবে প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল ভিকির। এর পর ‘রাজ়ি’, ‘বম্বে ভেলভেট’, ‘উরি, দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর মতো ছবির মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। ভিকির বাবা অভিনেতা নন ঠিকই, তবে ফিল্ম দুনিয়ার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ রয়েছে।
অনেকেই হয়তো জানেন না যে, ভিকির বাবা শ্যাম কৌশল এক জন স্টান্ট ডিরেক্টর। ‘দঙ্গল’, ‘বাজিরাও মস্তানি’, ‘পদ্মাবত’, ‘কৃষ ৩’-সহ ১০০টিরও বেশি ছবিতে স্টান্ট ডিরেক্টর হিসাবে কাজ করেছেন শ্যাম। ফলে ভিকির ‘বলিউড কানেকশন’ তাঁর বাবাই।
সম্প্রতি বিয়ে হয়েছে বলিউডের অন্যতম তারকা কিয়ারা আডবাণীর। ‘কবীর সিংহ’, ‘শেরশাহ’, ‘ভুল ভুলাইয়া ২’-এর মতো সুপারহিট ছবির নায়িকারও ভাগ্য খুলেছিল বলিউডের এক ‘কানকেশন’-এর হাত ধরে।
যদিও কিয়ারার পরিবারের সঙ্গে ফিল্মি দুনিয়ার কোনও যোগ নেই। তা সত্ত্বেও বলিউডে পা রেখে সফল হয়েছেন তিনি। তবে এর জন্য অনেকটাই অবদান রয়েছে নব্বইয়ের দশকের প্রথম সারির অভিনেত্রী জুহি চাওলার। কর্ণ জোহরের শোয়ে কিয়ারা জানিয়েছিলেন যে, একটি পার্টিতে এক পরিচালকের সঙ্গে তাঁকে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন জুহি।
রণবীর সিংহও কিন্তু বলিপাড়ার ‘বহিরাগত’ সদস্য নন। ছবির দুনিয়ায় পা রাখার আগে তাঁরও একাধিক পরিচিত মানুষ ছিলেন, যাঁরা বলিপাড়ার সদস্য। রণবীর চরিত্রাভিনেত্রী চাঁদ বুর্কের নাতি। শুধু তাই নয়, স্কুলে রণবীরের সহপাঠী ছিলেন অভিনেতা আদিত্য রায় কপূর।
অভিনেত্রী ইয়ামি গৌতমেরও ‘বলিউড কানেকশন’ রয়েছে। পঞ্জাবি চলচ্চিত্র দুনিয়ায় ইয়ামির বাবা মুকেশ গৌতম এক জন জনপ্রিয় পরিচালক। অভিনেত্রীর বোনও পঞ্জাবি ছবিতে কাজ করেন। সেই সূত্রেই অভিনয় জগতে পদার্পণ ইয়ামির।
বলিউডে তিন খান— শাহরুখ, সলমন, আমিরের রাজত্বের সঙ্গে সঙ্গেই যে সব নায়ক নিজেদের ভিতও মজবুত করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম অজয় দেবগন। বলিউডের এই সুপারস্টারের সঙ্গে চলচ্চিত্র দুনিয়ার যোগ শুরু থেকেই।
অজয়ের বাবা বীরু দেবগন বলিপাড়ার জনপ্রিয় অ্যাকশন কোরিয়োগ্রাফার ছিলেন। ‘ইশক’, ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’-সহ একাধিক ছবির অ্যাকশন দৃশ্যের কোরিয়োগ্রাফি করেছেন তিনি। অজয়ের মা-ও বলিপাড়ায় পরিচিত মুখ। বীণা দেবগন এক জন প্রযোজক।
‘কহো না প্যায়ার হ্যায়’ ছবির নায়িকা আমিশা পটেল। তবে এই ছবির আগে তাঁরও বলিউড-যোগ ছিল। আমিশার দাদু রজনী পটেল ছিলেন মুম্বই কংগ্রেসের সভাপতি। ফলে আমিশার পরিবার প্রভাবশালী। শোনা যায়, ‘কহো না প্যায়ার হ্যায়’ ছবিতে আমিশাকে নেওয়া হয়েছিল কারণ নায়িকার বাবার সঙ্গে পরিচালক রাকেশ রোশনের বন্ধুত্ব ছিল।
আমির খানের স্ত্রী ছিলেন তিনি। সেই সুবাদে বলিপাড়ার সঙ্গে পরিচিতি ঘটেছিল কিরণ রাওয়ের। কিরণের সঙ্গে আবার অভিনেত্রী অদিতি রায় হায়দরির যোগাযোগ রয়েছে। ফলে অদিতির বলিউডের কানেকশন হলেন কিরণ।
হায়দরাবাদে নিজামের আমলে কিরণের দাদু এবং অভিনেত্রী অদিতি রায় হায়দরির মামাতো দাদু জে রামেশ্বর রাও ছিলেন ওয়ানাপার্থির রাজা। এই সূত্রেই কিরণ এবং অদিতির যোগাযোগ রয়েছে।
বলিপাড়ার উঠতি নায়িকা তারা সুতারিয়ার পরিবারের কেউই বলিপাড়ার সঙ্গে যুক্ত নন। তবে নায়িকার বলিউড যোগ ছিল। শোনা যায়, ‘স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ার ২’ ছবির নায়িকার পরিবারের সঙ্গে বলিপাড়ার ‘হার্টথ্রব’ জন আব্রাহামের ভাল সম্পর্ক রয়েছে। আবার কপূরদের সঙ্গেও তারার পরিবারের ভাল যোগাযোগ রয়েছে।
জনের সঙ্গে তাঁর পরিবারের সুসম্পর্কের কথা নিজেই জানিয়েছিলেন তারা। বলেছিলেন, ‘‘জনের পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিবারের খুব ভাল বন্ধুত্ব। ছোট থেকেই জনকে চিনি। কখনও ভাবিনি যে একসঙ্গে ছবির দুনিয়ায় কাজ করব।’’
সুনীল শেট্টি। নব্বইয়ের দশকের বলি নায়ক। তাঁর পরিবারের কেউ চলচ্চিত্র দুনিয়ায় কাজ না করলেও বলিউডের সঙ্গে শেট্টিদের যোগাযোগ ছিল। সুনীলের বাবা বীরাপ্পা শেট্টি ছিলেন হোটেল ব্যবসায়ী। শোনা যায়, তাঁর সঙ্গে ফিল্ম দুনিয়ার অনেকেরই যোগাযোগ ছিল।
উপরোক্ত তালিকায় যে ক’জন তারকার কথা তুলে ধরা হল, তাঁদের অনেকেরই পরিবারের সদস্য সরাসরি ভাবে বলিউডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না ঠিকই। কিন্তু, তাঁদের সকলের সঙ্গেই কোনও না কোনও ভাবে বলিউডের যোগসূত্র ছিল। এখন এ কথা জেনে অনেকে বলতে পারেন, এই লাইনে যোগাযোগ না থাকলে কিস্যু হয় না! তবে এমন অনেকেই রয়েছেন যাঁদের বলিউডে কোনও ‘লিঙ্ক’ই ছিল না। অথচ তাঁরা নিজের দমে বি-টাউনে নিজেদের জায়গা পোক্ত করেছেন। শাহরুখ খান, প্রিয়ঙ্কা চোপড়া তাঁর জ্বলন্ত উদাহরণ। আবার ‘স্টারকিড’ হয়েও ব্যর্থ হওয়ার উদাহরণও রয়েছে ভূরি ভূরি।
সুশান্ত সিংহ রাজপুতের আকস্মিক প্রয়াণের পর বলিউ়ডে স্বজনপোষণের অভিযোগ নিয়ে সরগরম হয়েছিল বলিপাড়া। এ নিয়ে তর্কবিতর্ক চলবেই। তবে গুণীজনেরা বলেন, আসল হল যোগ্যতা আর প্রতিভা। সেটা যদি থাকে, তা হলে কোনও না কোনও দিন তা ঠিকরে বেরোবেই। হয়তো বলিউডে পা রাখা একটা যেমন লড়াই, তেমনই পা রেখে সেখানে দাঁড়ানোটাও আরেকটা লড়াই। তবে সকলে সেই লড়াইয়ে টিকতে পারেন না। যাঁরা টিকে যান, তাঁরাই ‘বাজিগর’।