ভুটানের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বাণিজ্য, পরিকাঠামো এবং শক্তি ক্ষেত্রে আদানপ্রদান বৃদ্ধি করার কথাও জানিয়েছে। কেন ভুটানকে এতটা গুরুত্ব দিচ্ছে ভারত? উত্তরটা লুকিয়ে রয়েছে ছোট্ট এই পাহাড়ি দেশের অবস্থানে।
৩ নভেম্বর ভারত সফরে এসেছেন ভুটানের রাজা জিগমে খেসর নামগিয়াল ওয়াংচুক। ৬ নভেম্বর তাঁর সঙ্গে একটি বৈঠকে বসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেখানেই দুই দেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে মজবুত করার বিষয়ে সহমত হয়েছে।
বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতি দিয়েছে দুই প্রতিবেশী দেশ। জানিয়েছে, অসমের কোকরাঝাড় থেকে ভুটানের গেলেফু পর্যন্ত ট্রেন পরিষেবা চালুর জন্য জমি দেখার বিষয়ে সহমত হয়েছে দুই দেশ। পশ্চিমবঙ্গের বানারহাট থেকে ভুটানের সামৎসে পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু করারও চিন্তাভাবনা চলছে।
তবে ভারত, ভুটান, চিনের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে যে সমস্যা রয়েছে, সেই বিষয়ে কথা হয়েছে কি না, তা জানাতে চায়নি নয়াদিল্লি এবং থিম্পু।
সম্প্রতি বেজিংয়ে সীমান্ত সমস্যা নিয়ে বৈঠকে বসেছিল চিন এবং ভুটান। সেই ২৫তম সীমান্ত বৈঠকের উপর নজর রয়েছে ভারতের। সূত্রের খবর, ওই বৈঠকে সহযোগিতা করার বিষয়ে চুক্তি করেছে দুই দেশ। ভুটান-চিন সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের যুগ্ম প্রযুক্তিগত দলের কী কী কর্তব্য, তা নিয়ে সহমত হয়েছে তারা।
চিনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। তবে ১৯৮৪ সাল থেকে সীমান্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে দুই দেশ। মূলত তিনটি অঞ্চল নিয়ে জট। জাকারলুঙ্গ, উত্তর ভুটানের পাসামলুঙ্গ এবং পশ্চিম ভুটানের ডোকলাম।
আর এই ডোকলাম উপত্যকা তার অবস্থানের জন্য ভারতের কাছে কৌশলগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শিলিগুড়ি করিডোরের খুব কাছে রয়েছে এই উপত্যকা। ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই শিলিগুড়ি করিডোরই (যাকে বলে চিকেন’স নেক) ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে জুড়ে রেখেছে উত্তর-পশ্চিমকে।
২০১৭ সালে এই ডোকলামেই মুখোমুখি হয়েছিল ভারতীয় সেনা এবং চিনের পিপল’স লিবারেশন আর্মি। ৭৩ দিন ধরে সংঘর্ষ হয়েছিল দুই বাহিনীর।
‘বিতর্কিত’ এই ডোকলাম ভূখণ্ডে চিনের নির্মাণকাজে বাধা দিয়েছিল ভারত। সেই নিয়ে বিবাদ। এর পরেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (এলএসি)-তে সেনার সংখ্যা বৃদ্ধি করে চিন। তার জেরেই ২০২০ সালে পূর্ব লাদাখে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় ভারত এবং চিনের সেনাবাহিনীর।
তার পর থেকে দফায় দফায় আলোচনায় বসেছেন দুই দেশের সামরিক কর্তারা। যদিও রফাসূত্র এখনও অধরা।
৩ নভেম্বর আট দিনের সফরে ভারতে এসেছেন ভুটানের রাজা জিগমে। তিন মাস পর ভুটানে ভোট। ভারত সফরে আসার ঠিক দু’দিন আগে নয় সদস্যের অন্তর্বর্তী সরকার নিয়োগ করেছেন রাজা। এই অন্তর্বর্তী সরকারই দেখবে নির্বাচনের বিষয়টি।
বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং তাঁর মন্ত্রিসভার শেষ বৈঠকে জানিয়েছেন, তাঁর সরকার সফল ভাবে পাঁচ বছরের শাসনকাল পার করেছে। কোনও ‘ভয় বা পক্ষপাত’ ছাড়া।
মনে করা হচ্ছে, ২০২৪ সালের ভুটানের নির্বাচন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। শুধু সে দেশের জন্য নয়, নয়াদিল্লির জন্যও। ভোটপূর্ব সমীক্ষা বলছে, আসন্ন ভোটে জিতে ভুটানে ফের ক্ষমতায় আসতে পারে পিপল’স ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (পিডিপি)। সে ক্ষেত্রে লাভ ভারতেরই।
পিডিপির সভাপতি শেরিং টোবগে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার বিষয়ে বদ্ধপরিকর। ভুটানে শিল্পের প্রসারে আগ্রহী তারা। আর এ ক্ষেত্রে ওই দল অনেকটাই তাকিয়ে ভারতের দিকে। ভারত থেকে বিনিয়োগ টেনে নিয়ে যেতে চায় পিডিপি, যাতে আখেরে সুবিধা এ দেশেরই।
এর ফলে এ দেশের শিল্পপতিরা ভুটানে বিনিয়োগের সুযোগ পাবেন। দুই দেশের ব্যবসায়িক সম্পর্ক অনেক মজবুত হবে।
অন্য দিকে, বিদায়ী শেরিং সরকার বেশ কিছু কারণে সমালোচনার মুখে পড়েছে। কোভিড বিধি লঘু হওয়ার পর ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বিদেশি পর্যটকদের থেকে ‘উন্নয়ন ফি’ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এই সরকার। প্রতি রাতে ৬৫ ডলার থেকে ২০০ ডলার পর্যন্ত ফি দিতে বাধ্য থাকছেন পর্যটকেরা। ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৫ হাজার টাকা থেকে ১৬ হাজার টাকা।
এই নীতির ফলে পর্যটক হারায় ভুটান। চলতি বছরের শুরুতে এই ‘উন্নয়ন ফি’ অর্ধেক করে দেয় ভুটান সরকার। মনে করা হচ্ছে, নতুন সরকার এই ফি তুলে নিতে পারে।
ঠিক এই কারণে ভুটানের নির্বাচন ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ভোটে জিতে কোন দল ক্ষমতায় আসে, তার উপর অনেকটাই নির্ভর করছে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক। আর সেই সম্পর্ক মজবুত হলে তবেই সীমান্তে শান্তি ফিরবে। চিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আরও মজবুত হবে।