মঙ্গলবার মধ্যরাতে এক অমূল্য রতন হারাল বলিউড— সুরকার-গায়ক বাপ্পি লাহিড়ির প্রয়াণের খবর শুনে এমনই বলছেন অনেকে। বলবেনই তো! বলিউডি ছবিতে সিন্থেটিক ডিস্কো মিউজিকের সুর ঢেলে দেওয়ায় তাঁর অবদানের কথা কি এত সহজে ভোলা যায়! তেমনই ভাবা যায় না সোনার গয়না ছাড়া বাপ্পি লাহিড়িকে।
নিজের তৈরি সুরের মতোই কম চটকদার ছিলেন না অলোকেশ লাহিড়ি থুড়ি বাপ্পি’দা। অলোকেশ নামটির সঙ্গে বরং বেশ অপরিতিচিতই ছিল বলিউড। তবে এক লহমায় বাপ্পি’দার সুর চিনে নিতে ভুল হত না।
গায়কিতেও তিনি আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা ছিলেন। হিন্দিতে বাঙালি উচ্চারণের ছাপ স্পষ্ট। তবে ৬৯ বছরের বাপ্পি’দার গলায় ছিল চিরসবুজের ছোঁয়া। এক দিকে ‘অমর সঙ্গী’, ‘আশা ও ভালবাসা’ বা ‘আমার তুমি’-র মতো বহু বাংলা ছবিতে সুর দেওয়ার পাশাপাশি নেপথ্য গায়ক হিসাবেও সুপারহিট বাপ্পি’দা।
বাংলার থেকে তুলনামূলক ভাবে হিন্দিতেই বেশি কাজ করেছেন। আশি ও নব্বইয়ের দশকে মিঠুন চক্রবর্তীর ছবিতে বাপ্পি’দার গান— সুপারহিট জুটি হয়ে গিয়েছিল। ডিস্কো নাচিয়ে হিসাবে মিঠুনের খ্যাতির পিছনেও জড়িয়েছিল জলপাইগুড়ির অপরেশ এবং বাঁশরী লাহিড়ির ছেলের তৈরি সুর। আবার তাঁর সুরে নেচেছেন অমিতাভ বচ্চন থেকে শুরু বলিউডের বহু তারকা। ‘ডিস্কো ডান্সার’, ‘ডান্স ডান্স’, ‘নমক হলাল’, ‘শরাবি’— একের পর এক সুপারহিট ছবিতে অপ্রতিরোধ্য বাপ্পি।
মা-বাবার কাছে সঙ্গীতের শিক্ষা ছোট্ট অলোকেশের। তিন বছর বয়স থেকে তবলায় বোল তুলেছেন। তার পর থেকে দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন ড্রামস, পিয়ানো, গিটার, স্যাক্সোফোন, বঙ্গো বা ঢোলকের মতো অজস্র বাদ্যে। পরে যে শিক্ষাকে কাজে লাগিয়েছেন সুরকার বাপ্পি লাহিড়ি।
স্বকীয় ছাপের সুরের মতো ভাবমূর্তিতেও স্বতন্ত্র তিনি। ওজনদার ছোটখাটো চেহারায় গা ভর্তি সোনার গয়না। গলায় সোনার একাধিক ভারী চেন। তাতে ঝুলত বড়সড় লকেট। হাতের সব আঙুলে সোনা-রুপোর আংটি। তাতে বসানো বহুমূল্য পাথর। কব্জিতে ব্লেসলেট। বাদ পড়েনি কানের লতিও। তাতে হরেক সাইজের দুল পরতেন। চুলের ছাঁটেও কম কেতা ছিল না। এবং অবশ্যই একটি ওজনদার রোদচশমা। তবে তাঁর সোনার গয়না নিয়েই ঘুরেফিরে প্রশ্ন আসত বাপ্পি’দার কাছে।
সুরের জগতের বাসিন্দাটি এক বার রাজনীতিতেও পা রেখেছিলেন। সেটি ছিল ২০১৪ সাল। শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে বিজেপি-র টিকিটে লড়েছিলেন তিনি। যদিও শেষমেশ ওই কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে হেরে যান তিনি।
তবে লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থী হিসাবে সম্পত্তির হলফনামা দায়ের করার সময় নিজের সোনার গয়নার হিসাবও দিতে হয়েছিল বাপ্পি’দাকে। ২০১৪ সালে হলফনামায় তিনি জানিয়েছিলেন, ৭৫৪ গ্রামের সোনার গয়না রয়েছে তাঁর। সঙ্গে ৪.৬২ কিলোগ্রামের রুপোর গয়না। এ ছাড়াও চার লক্ষ টাকার একটি হিরের আংটিও রয়েছে। তার পর থেকে আট বছর গড়িয়ে গিয়েছে। বাপ্পি’দার গয়নার বাক্সে সম্ভবত আরও সোনাদানা ঢুকেছে।
সোনার গয়নার প্রতি আপনার এত টান কেন বাপ্পি’দা? তারকা-সুরকারের কাছে এ প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন বহু সাংবাদিক থেকে উৎসাহী। এক বার তো ‘ইন্ডিয়ান আইডল’-এর এক পর্বে সরাসরি সে প্রশ্ন করে বসেন এক প্রতিযোগী।
টেলিভিশনের মিউজিক রিয়েলিটি শোয়ে সে বার বিচারকের আসনে ছিলেন বাপ্পি লাহিড়ি। ১২তম পর্বের প্রতিযোগীরা গান শেষ করেছেন। সে বার বিচারক বাপ্পির দিকে প্রশ্ন ছিল ওই মরসুমের প্রতিযোগী দানিশের। ‘‘আপনার স্টাইল আর সোনার গয়না দারুণ লাগে। এই স্টাইলের পিছনে কার অনুপ্রেরণা রয়েছে?’’ প্রশ্ন ছিল তাঁর।
সদা হাস্যময় বাপ্পি’দা যেন এ হেন প্রশ্নেরই অপেক্ষায় ছিলেন। অকপটে জানিয়েছিলেন সোনার গয়নার প্রতি তাঁর ঝোঁকের কথা। তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমার প্রথম ছবি ‘জখমি’ দারুণ সফল হয়েছিল। তাতে মা একটা সোনার হার উপহার দিয়েছিলেন। তার পর থেকে সোনা আমার কাছে সৌভাগ্যের প্রতীক হয়ে গিয়েছিল। কারণ, এর পর প্রতিটি গানই হিট।’’
বাপ্পি’দার গা-ভর্তি সোনার গয়নার নেপথ্যে এলভিস প্রেসলিরও কম অবদান ছিল না। এলভিসের গলাতেও ঝুলত ভারী সোনার ক্রশ। এক সময় ওটাই তাঁর স্টাইল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ‘কিং অব রক অ্যান্ড রোল’-কে নিজের অনুপ্রেরণা মনে করা বাপ্পি’দা বলেছিলেন, ‘‘এলভিস প্রেসলির যে ভাবে নিজের ভাবমূর্তি তৈরি করেছিলেন, তাতে একেবারে মুগ্ধ ছিলাম। ভেবেছিলাম, আমাকেও ওঁর মতো নিজের পরিচিতি গড়ে তুলতে হবে।’’ জানিয়েছেন, হাতে টাকা এলে এলভিসের মতোই গলায় ভারী হার পরার ইচ্ছে ছিল। এক সময় সে ইচ্ছেও পূরণ হয়েছে বাপ্পি’দার।