তাঁর জীবনের গল্পটা একটু অদ্ভুত। ক্রিকেট ছিল ধ্যানজ্ঞান। সচিন তেন্ডুলকরের গুরু রমাকান্ত আচরেকর ছিলেন তাঁরও গুরু। তার পর কী হল? সেই গল্পে যাব, তার আগে তাঁর পরিবার এবং অতীত সম্পর্কে দু’চার কথা বলে নেওয়া যাক।
পুরো নাম উদয় সুরেশ কোটাক। গুজরাতি এক উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। যৌথ পরিবার ছিল। এক ছাদের তলায় ৬০ জন থাকতেন। রান্নাও হত এক সঙ্গে। মজা করে উদয় বলতেন, ‘কাজের জায়গায় পুঁজিবাদি আদর্শ মানা হত, আর বাড়িতে পুরোদস্তুর সমাজতন্ত্রের আদর্শ!’
পরিবারের সুতির কাপড় বোনা এবং তুলোর ব্যবসা ছিল। কিন্তু তিনি চাইতেন ওই ব্যবসার বাইরে গিয়ে কিছু করতে।
অঙ্ক ভাল লাগত। সঙ্গে সেতার শিখতেন। আর স্বপ্ন দেখতেন ক্রিকেটার হওয়ার। সেই মতো পরিশ্রম করতেন। ক্লাব স্তরে নিয়মিত খেলতেন।
যে সময়ের কথা, তখন তখন কঙ্গা লিগের একটি ম্যাচে ক্রিজে ছিলেন উদয়। ছিলেন নন স্ট্রাইকার এন্ডে।
স্ট্রাইকে থাকা ব্যাটার একটি শট খেলে রানের জন্য দৌড় দেন। ফিল্ডার বলটি ধরেন এবং ছুড়ে দেন। বল লাগে উদয়ের মাথায়। গুরুতর জখম হন। অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়।
বেশ কিছু দিন ভোগার পর সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু এই চোটের পর আর সে ভাবে ক্রিকেট মাঠে ফিরতে পারেননি তিনি।
পরে এক সাক্ষাৎকারে উদয় বলেছিলেন, ‘‘পেশাদার ক্রিকেটার না হতে পারার জন্য আমার এখনও আক্ষেপ রয়েছে। মাত্র ১৯ বছর বয়সে মাথায় বল লাগে। অস্ত্রোপচার হয়। এই ঘটনা আমার জীবন বদলে দেয়। এর পর থেকে আমার বাড়ির লোক আর সে ভাবে ক্রিকেট খেলতে দেননি।’’
অতঃপর পড়াশোনায় মন দিতে হয়। স্নাতক হওয়ার পর ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশোনা করে পরবর্তী লক্ষ্য স্থির করেন।
পাশ করার পর কিছু দিন পারিবারিক ব্যবসা সামলেছেন। ভাল লাগেনি। চাকরির খোঁজ করেন।
একটি নামী সংস্থায় বেশ ভাল মাইনের চাকরিও পেয়ে যান। কিন্তু অকস্মাৎ মত বদলান। ব্যবসা করবেন বলে মনস্থির করেন।
পরিচিতের কাছ থেকে কিছু অর্থ ধার করে নিজের একটি সংস্থা খোলেন। এই পরিচিতের মধ্যে ছিলেন আনন্দ মহিন্দ্রা।
আনন্দ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘সেটা ১৯৮৫। এক তরুণ আমার অফিসে আসেন। খুবই সপ্রতিভ লেগেছিল তাঁকে। উনি নতুন একটি ব্যবসা করার কথা বলেছিলেন। আমি ওঁকে বলি, আমি ওঁর ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে পারি কি না। এটাই ছিল আমার জীবনের সেরা সিদ্ধান্ত।’’ আনন্দের থেকে ১ লক্ষ টাকা পান উদয়। প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা পুঁজি করে খোলেন একটি আর্থিক সংস্থা।
আনন্দের সংযোজন ছিল, “আমার পরিষ্কার মনে আছে, বাবা এবং কাকা দু’জনেই বলেছিলেন, কেন এই আনকোরা ছোকরার উপর এত ভরসা করছি? আমি বলেছিলাম, আমার মন বলছে, এঁর সঙ্গে নিজেদের নাম জুড়তে পেরে এক দিন গর্ববোধ হবে। ওঁর সেই সম্ভাবনা নিয়ে একটা দৃঢ় আস্থা ছিল আমার।”
শুধুমাত্র কর্পোরেট চুক্তি নয়, এর পর আনন্দ এবং উদয়ের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব তৈরি হয়। এখনও তাঁরা পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। পরস্পরের কাজ সম্পর্কেও উচ্চকিত।
এর পর থেকে উদয়ের সংস্থার প্রসার ঘটে। শুরুর দিকে শুধু আর্থিক সংস্থা হিসাবেই কাজ করত।
২০০৩ সালের ২২ মার্চ কোটাক মহিন্দ্রা ফিন্যান্স লিমিটেড দেশের ইতিহাসে প্রথম কোনও কর্পোরেট সংস্থা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে যারা ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের থেকে ব্যাঙ্কিঙের লাইসেন্স পায়।
একটি হিসাব বলছে, উদয় এখন ১১ লক্ষ ৬ হাজার কোটির মালিক! মূলত উদয়ের ব্যবসায়িক নীতির কারণে কোটাক মাহিন্দ্রা ব্যাঙ্ক দেশের সেরা দশটি ব্যাঙ্কের মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত।
সম্প্রতি আরও একটি কারণে খবরের শিরোনামে উদয়। আইএল অ্যান্ড এফসি সংস্থাটির নন-এগ্জিকিউটিভ চেয়ারম্যান হয়েছিলেন উদয়। সংস্থাটি তখন দেনায় জর্জরিত। উদয় আসার পর সাড়ে তিন বছরে এই সংস্থার ৫৫ শতাংশ ঋণ শোধ হয়ে গিয়েছে।
ওই সংস্থার চেয়ারম্যান বলেছেন, মোট ৯৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৫৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ শোধ হয়েছে সাড়ে তিন বছরে। যে কৃতিত্ব প্রাপ্য উদয়ের।
খবরটি প্রকাশ্যে আসার পর হর্ষ গোয়েঙ্কা টুইট করেন, ‘উদয়ের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের ফলেই এত অল্প সময়ে এই পরিমাণ ঋণ শোধ করা সম্ভব হয়েছে। এই ভাবে দেশীয় সংস্থার পাশে থাকা কৃতিত্বের।’
এর পর উদয় বলেছিলেন, ‘‘এক জন ব্যাঙ্কার হিসেবে বলতে পারি এই অভিজ্ঞতা থেকে সব চেয়ে বড় শিক্ষা হল এই যে, যেখানে আপনি ব্যবসার কাঠামো বুঝতে পারছেন না, সেখানে ধার দেওয়া উচিত নয়।’’
দামি গাড়ির শখ নেই। নিজে মনে করেন না, দামি গাড়ি নিজের বিত্ত দেখানোর অন্তম মাধ্যম।
অতিমারিতে ধুঁকতে থাকা ভারতীয় অর্থনীতির এই মন্দাতেও কোটাক মহিন্দ্রা ব্যাঙ্কের মুনাফা ঈর্ষণীয়।
ব্যাঙ্কঋণ নিয়ে একের পর এক দুর্নীতিতে দেশের ব্যাঙ্কিং সেক্টর জর্জরিত হলেও তাতে উদয় বা তাঁর সংস্থার নাম এখনও পর্যন্ত জড়ায়নি। উল্টে গত দু’বছরেরও বেশি সময় বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করতে পেয়েছেন উদয়।
অতিমারির আবহে ঋণ শোধ করাই যখন গ্রহীতাদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে সময় আর্থিক ক্ষেত্রে যে সমস্ত সংস্থা পুঁজি জোগাড় করেছে, কোটাক মহিন্দ্রা ব্যাঙ্ক তাদের মধ্যে অন্যতম।
বিনিয়োগকারীদের কাছে লোভনীয় হয়ে উঠেছে উদয়ের সংস্থার শেয়ার। এবং এই কৌশলে ফলও মিলেছে হাতেনাতে। ২০২০ সালে কোটাক মহিন্দ্রার শেয়ারদর বাড়ে ১৭ শতাংশ। সেই ধারা অব্যাহত থেকেছে পরবর্তী সময়েও।
মূলত বিনিয়োগ সংস্থা হিসেবে পথচলা শুরু করলেও বিভিন্ন দিকে শাখা ছড়িয়েছে উদয়ের সংস্থা। লোন পোর্টফোলিয়ো থেকে স্টক ব্রোকিং, ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং, বিমা অথবা মিউচ্যুয়াল ফান্ড— বিনিয়োগকারীদের কাছে নানা পথ খুলে দিয়েছেন উদয়।
যে কারণেই হয়তো বন্ধুর প্রশংসা করে আনন্দ বলেছিলেন, “আমার মতে, বিশ্বের স্মার্ট ব্যাঙ্কারদের অন্যতম উদয়। বিশ্বের ধনীতম ব্যাঙ্কার হওয়ার পথে আমরা শুধু তাঁর হয়ে ‘প্রক্সি ব্যাঙ্কার’ হিসেবে কাজ করেছি। সব চেয়ে বড় কথা, উদয় জানেন কী ভাবে সুশাসন আর স্মার্ট কৌশলের মাধ্যমে ব্যাঙ্ককে টিকিয়ে রাখতে হয়।”
ক্রিকেটের ওই বল মাথায় না লাগলে কি এত কিছু সম্ভব হত? সাধে কি বলে, বাস্তব অনেক সময় রূপকথাকেও হার মানায়!