তিন বছরের ছোট্ট আরিহা শাহকে দেশে ফেরাতে মরিয়া কেন্দ্র। মা-বাবাকে ছেড়ে জার্মানির একটি হোমে রয়েছে সে। বিষয়টি নিয়ে সে দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে কথা বলেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু, তার পরেও পরিস্থিতি অনুকূল নয় বলেই স্পষ্ট করেছে বিদেশ মন্ত্রক।
চলতি বছরের ২৫ অক্টোবর রাজধানী দিল্লিতে জার্মান চ্যান্সেলার ওলাফ স্কোলজ়ের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন মোদী। সেখানে ওঠে আরিহা প্রসঙ্গ। পরে এই নিয়ে বিবৃতি দেয় বিদেশ মন্ত্রক। সেখানে আরিহার ব্যাপারে কেন্দ্রের উদ্বেগের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
২৫ অক্টোবর ভারতের বিদেশসচিব বিক্রম মিশ্রি বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে জার্মান চ্যান্সেলার আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। গোটা বিষয়টি নিবিড় ভাবে পর্যাবেক্ষণ করার কথা জানিয়েছেন তিনি। ফলে আমরা আশাবাদী।’’
কে এই আরিহা? কেন মা-বাবার থেকে ছিনিয়ে তিন বছরের ওই একরত্তিকে আটকে রেখেছে জার্মান সরকার? মেয়েটির মা-বাবার নাম ভাবেশ ও ধারা। পেশায় সফ্টঅয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ভাবেশ গুজরাতের বাসিন্দা। ২০১৮ সালে স্ত্রী ধারাকে নিয়ে জার্মানির রাজধানী বার্লিন চলে যান তিনি।
বার্লিনে একটি সফটঅয়্যার সংস্থায় চাকরি করতেন ভাবেশ। ২০২১ সালে তাঁদের সংসারে আসে নতুন অতিথি। এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন ধারা। আদর করে মা-বাবা তার নাম রাখে আরিহা।
গুজরাতি পরিবারটির দাবি, সাত মাস বয়সে এক দিন হঠাৎই আরিহার যৌনাঙ্গে আঘাত লাগে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যান ভাবেশ ও ধারা। আঘাত দেখে জার্মান চিকিৎসকের সন্দেহ হয়। শিশুটিকে যৌন নিগ্রহ করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
এর পরই আরিহাকে মা-বাবার থেকে আলাদা করে দেয় জার্মান সরকার। সেখানকার নিয়ম অনুযায়ী, মেয়েটিকে একটি হোমে নিয়ে যাওয়া হয়। ভাবেশ ও ধারার শত অনুনয়-বিনয়তেও কাজ হয়নি। তখন বাধ্য হয়ে ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তাঁরা।
বর্তমানে আরিহাকে ‘জুজেন্ডামট’-এর হেফাজতে রেখেছে জার্মান সরকার। যা প্রকৃতপক্ষে সেখানকার যুব কল্যাণ দফতর। প্রতি ১৫ দিনে একবার করে সন্তানের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পেয়েছেন ভাবেশ ও ধারা।
আরিহার পরিবারের অনুরোধে তাকে মা-বাবার কাছে ফিরিয়ে দিতে ক্রমাগত জার্মান সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ভারত সরকার। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রে খবর, এই ঘটনা দুই দেশের সম্পর্কেও প্রভাব ফেলেছে।
সম্প্রতি শিশুটির উপর যৌন হেনস্থার অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিয়েছে জার্মান সরকার। তবে আরিহার আঘাত পাওয়ার নেপথ্যে মা-বাবার গাফিলতিকে দায়ী করেছেন তারা। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভাবেশ-ধারার বিরুদ্ধে যাবতীয় অভিযোগ তুলে নেওয়া হয়। তার পর নতুন করে আর কোনও মামলা রুজু করেননি জার্মান কর্তৃপক্ষ।
আরিহাকে মা-বাবার কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে নতুন আইনি জটিলতা। জার্মান জুজেন্ডামট শিশুটির উপর মা-বাবার অধিকার বাতিলের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হয়। সেখানে আজীবন আরিহার হেফাজত চেয়ে বসে মধ্য ইউরোপের দেশটির যুব কল্যাণ দফতর।
সেই মামলায় তাৎপর্যপূর্ণ রায় দিয়েছে বার্লিনের আদালত। সেখানে বলা হয়েছে, শিশুটির সর্বোত্তম দেখভালের জন্য তাকে জুজেন্ডামটে রাখতে হবে। আরিহার আঘাত দুর্ঘটনাবশত হয়েছিল বলে মানতে রাজি ছিল না আদালত।
এই পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে আরিহাকে ছাড়াই দেশে ফিরেছেন ভাবেশ ও ধারা। মেয়েকে ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন এখনও দেখে চলেছেন তাঁরা। এই নিয়ে গত বছর দেওয়া বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, ‘‘আমাদের সরকারের উপর বিশ্বাস রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর অবশ্যই ওকে আমাদের কোলে ফিরিয়ে দেবেন।’’
আরিহাকে ঘরে ফেরাতে ইতিমধ্যেই পথে নেমেছে জৈন সম্প্রদায়। ‘আরিহাকে রক্ষা কর’ (সেভ আরিহা) শীর্ষক একটি প্রচারাভিযান শুরু করেছেন তাঁরা। এই সম্প্রদায়ের অভিযোগ, তিন বছরের মেয়েটির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যতে ভুলিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে জার্মান সরকার। আর তাই ইচ্ছাকৃত ভাবে তাকে আটকে রাখা হয়েছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন, ‘‘আরিহাকে নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। কারণ, শিশুটির নিজস্ব ভাষাগত, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক পরিবেশে বড় উচিত বলে আমরা মনে করি। এ ব্যাপার আমাদের দূতাবাস ক্রমাগত জার্মান সরকারকে চাপ দিয়ে যাচ্ছে। মন্ত্রী হিসাবে বিষয়টির দিকে আমিও নজর রাখছি।’’
এ বছরের ২৫ অক্টোবর মোদী-স্কোলজ় বৈঠকের পর ভারতের বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রি বলেন, ‘‘ব্যাপারটা খুব ভাল ভাবে নজরে রাখা হচ্ছে। বার্লিনে আমাদের দূতাবাস এটা দেখছে। কয়েক দিন আগে বিদেশমন্ত্রী জার্মানি সফরে গিয়েছিলেন। সেখানে জার্মান বিদেশমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি উত্থাপন করেন তিনি।’’
আরিহার ব্যাপারে মুখ খুলেছে দিল্লির জার্মান দূতাবাসও। ‘‘তিন বছরের মেয়েটিকে সুস্থ রাখা আমাদের কর্তব্য। এ ব্যাপারে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পালক সংস্থাকে আরিহার সাংস্কৃতিক পটভূমি বিবেচনা করতে বলা হয়েছে।’’ স্পষ্ট করেছেন জার্মান রাষ্ট্রদূত ফিলিপ অ্যাকারম্যান।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, মোদী-স্কোলজ় বৈঠকের পর আরিহার দ্রুত ঘরে ফেরার সম্ভাবনা অনেকটাই উজ্জ্বল হয়েছে। আগামী তিন থেকে চার মাসের মধ্যে গোটা প্রক্রিয়া শেষ করা যাবে বলে মনে করছেন তাঁরা।