যৌনচক্র চালিয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ব্ল্যাকমেল এবং লাখ লাখ টাকা আদায়ের অভিযোগে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার হয়েছেন ওড়িশার ‘সিরিয়াল ব্ল্যাকমেলার’ অর্চনা নাগ। তাঁকে নিয়ে তোলপাড় ওড়িশার রাজ্য রাজনীতি।
গত ৬ অক্টোবর অর্চনাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তার পর থেকে তাঁর ঠিকানা ভুবনেশ্বরের ঝড়পাড়ার বিশেষ জেল।
কর্তৃপক্ষের দাবি, জেলে আসার পর থেকে একেবারে স্বাভাবিক আচরণ করছেন অর্চনা। তাঁর চোখে-মুখে কোনও উদ্বেগ বা অনুতাপের লেশমাত্র নেই।
অর্চনাকে যে সেলে রাখা হয়েছে, সেই সেলের সহবন্দিদের মধ্যে তাঁকে নিয়ে বেশ কৌতূহল লক্ষ করা গিয়েছে। তাঁরা অর্চনার মুখ থেকে তাঁর জীবনের রঙিন কাহিনি শোনার জন্য মুখিয়ে রয়েছেন। কিন্তু তাঁদের খুব একটা পাত্তা দিচ্ছেন না বলেও জেল সূত্রে খবর।
জেলের এক আধিকারিক বলেন, “তাঁকে নিয়ে কোন কোন সংবাদমাধ্যম কী কী বলছেন, তাঁর বিরুদ্ধে কী কী তথ্য তুলে তুলে ধরা হচ্ছে, সব কিছু নজরে রাখছেন অর্চনা।”
ওই আধিকারিক আরও জানিয়েছেন, দিনের বেশির ভাগ সময়ই টিভিতে খবর দেখে কাটাচ্ছেন অর্চনা। জেলে সকালে টিভি চালু করা হয়। রাত ১০টা পর্যন্ত টিভি চালানোর অনুমতি রয়েছে। আর এই সময়ের বেশির ভাগটাই খবর দেখছেন অর্চনা।
জেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, বিচারাধীন বন্দিদের কাজে নিয়োগ করার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। তবুও অনেক বিচারাধীন মহিলা বন্দি স্বেচ্ছায় সরষের তেল, মুড়ি, আটা এবং নানা খাদ্যদ্রব্য বানানোর কাজ করেন। কিন্তু অর্চনার এ সবে কোনও আগ্রহ নেই।
গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে জেলের ভিতরে কারও সঙ্গে খুব একটা কথা বলেননি অর্চনা। যখনই ইচ্ছা হচ্ছে টিভি চালিয়ে তাঁর সম্পর্কিত খবরগুলি নজর রাখছেন।
ওড়িশার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে, অর্চনার যৌনচক্রের ফাঁদে পড়েছেন ওড়িশার ২৫ জন রাজনীতিক। তাঁদের মধ্যে ১৮ জন বিধায়ক এবং দুই মন্ত্রীও রয়েছেন। যা নিয়ে রাজ্য রাজনীতি তোলপাড় হচ্ছে।
রাজ্যের বিরোধী দল তাঁর সঙ্গে শাসক দল বিজেডিকে জড়িয়ে কী কী মন্তব্য করছে, কোন কোন অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে আনা হচ্ছে, সব কিছু নজরে রাখছেন অর্চনা।
জেল সূত্রে খবর, যে বিলাসবহুল জীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত অর্চনা, তাতে জেলের খাবার খেতে অসুবিধা হতে পারে বলে তাঁর আইনজীবী ৫০০ টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই টাকা দিয়ে জেল ক্যান্টিন থেকে বিস্কুট, শুকনো ফল-সহ নানা রকম খাবার কিনে খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু অর্চনা সেই টাকা নিতে অস্বীকার করেছেন। শুধু তাই নয়, বন্দিদের জন্য বরাদ্দ জেলের খাবারই খাচ্ছেন তিনি।
ভুবনেশ্বরের ঝড়পাড়া জেলে মূলত কুখ্যাত অপরাধী, গ্যাংস্টার, মাওবাদীদের রাখা হয়। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় মোড়া এই জেলে বন্দিদের জন্য রয়েছে একটি স্কুল। ১০ শয্যার একটি হাসপাতাল, ভলিবল খেলার মাঠ। এ ছাড়াও রয়েছে নানা রকম ইন্ডোর গেমসের সুবিধাও।
আদালতের কাছে জামিনের আবেদন করেছিলেন অর্চনা। কিন্তু শুক্রবার মহকুমা আদালত তাঁর জামিনের নির্দেশ আপাতত স্থগিত রেখেছে। আদালতে অর্চনার আইনজীবী দেবাশিস মহাপাত্র দাবি করেছেন, তাঁর মক্কেলকে ফাঁসানো হচ্ছে। যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এর পরই অর্চনার জামিনের আর্জিন জানান তিনি।
অন্য দিকে, সরকারি আইনজীবী এ চাঁদ জানিয়েছেন, অর্চনার বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৬, ৩৭০, ৩২৮ এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬ (ই) এবং ৬৭ ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে। সরকারি আইনজীবী আদালতে জানিয়েছেন, অর্চনাকে জামিন দেওয়া খুবই বিপজ্জনক। কারণ, তিনি জামিন পেলেই তদন্তে প্রভাব খাটাতে পারেন। দু’পক্ষেরই কথা শোনার পর অর্চনার জামিন আপাতত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আদালত।
দরিদ্র পরিবারে বেড়ে উঠেছেন অর্চনা। কালাহান্ডিতে স্কুলজীবন শেষের পর ভুবনেশ্বরে আইন নিয়ে পড়াশোনা করতে চলে আসেন বলে পুলিশ সূত্রে খবর। আর এখান থেকেই তাঁর জীবন অন্য খাতে বয়ে যায়। কালাহান্ডির একটি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠা আসা অর্চনা অল্প সময়ে বেশি টাকা উপার্জনের রাস্তা খুঁজতে শুরু করেন।
পুলিশ সূত্রে খবর, ধনী এবং প্রভাবশালীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেন অর্চনা। তার পর তাঁদের কখনও নিজের বাড়িতে ডেকে নিয়ে এসে মহিলাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ করে দিতেন। শুধু তাই নয়, ওই ব্যক্তিদের চাহিদা মতো মহিলাও সরবরাহ করতেন।
শুধু মহিলা সরবরাহ করাই নয়, নিজেও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে মোবাইলে ঘনিষ্ঠ কথাবার্তা, বাড়িতে ডেকে নিয়ে এসে তাঁদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হতেন বলে পুলিশ সূত্রে খবর। আর সেই ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি এবং ভিডিয়ো করতেন তাঁর স্বামী জগবন্ধু। তার পর সেই ছবি এবং ভিডিয়ো দেখিয়ে প্রভাবশালীদের ব্ল্যাকমেল করে লাখ লাখ টাকা আদায় করতেন।
পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, ওড়িশার ৫০ জন খ্যাতনামী ব্যক্তিদের একটি তালিকা তৈরি করেছিলেন অর্চনা। তাঁদের মধুচক্রের শিকার বানিয়ে ব্ল্যাকমেল করে টাকা হাতানোর পরিকল্পনা ছিল তাঁর।
সময় যত গড়িয়েছে, অর্চনার জীবনযাপনের ধারাও বদলেছে। বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়েছেন। ভুবনেশ্বরে ৩ কোটি টাকার প্রাসাদোপম বাংলো, নাখারার কাছে একটি সুবিশাল ফার্মহাউস রয়েছে তাঁর।
শুধু বিলাসবহুল বাড়িই নয়, গাড়ির একটি শোরুম আছে অর্চনার। কয়েক লক্ষ টাকার দামি দামি বিলাসবহুল বেশ কয়েকটি গাড়ি, বেশ কয়েকটি এসইউভিও আছে অর্চনার। পুলিশ জানিয়েছে, বেছে বেছে বিত্তশালী লোকেদেরই তাঁর শিকার বানাতেন অর্চনা। তার মধ্যে কয়েক জন চলচ্চিত্র নির্মাতাও রয়েছেন।