তিন বছর আগেও একবার তাঁকে নিয়ে হইচই পড়েছিল খুব। তখন বাঙালি মেয়ে অঙ্কিতি বসু সবে আকাশ ছুঁয়েছেন। দেশের প্রথম মহিলা যিনি ১০০ কোটি ডলারের একটি ই –কমার্স সংস্থার মালিক। এশিয়ার কনিষ্ঠতম চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার। কুটো থেকে নিজের হাতে গড়া সংস্থাকে কোটিতে পৌঁছে দিয়েছেন যিনি। সেই অঙ্কিতি তিন বছর পর আবার খবরে।
নতুন সাফল্য? নাহ। বরং ব্যর্থতাই বলা চলে। তাঁর সেই সংস্থা থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে তাঁকে। মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে কলঙ্কের ঝুড়ি। নিজের সংস্থা আর সম্মান ফিরে পেতে এখন আইনি লড়াই লড়ছেন অঙ্কিতি। যাঁকে একরকম আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই দরজা দেখিয়েছে তাঁর সংস্থা।
এমন আকস্মিক পতনের কোনও না কোনও কারণ থাকে! অনেক সময় নিজের টুকরোটাকরা দোষও মন্দভাগ্যের ফেরে রাক্ষুসে রূপ নেয়। তবে অঙ্কিতির দাবি, এক্ষেত্রে তেমন কোনও কারণ ঘটেনি। তিনি নতুন করে এমন কিছু করেননি যা গত সাত বছর ধরে করছেন না।
তার পরও অঙ্কিতির বিরুদ্ধে হিসেবে গরমিল করার অভিযোগ এনেছে তাঁর সংস্থা। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই এই অভিযোগে সাসপেন্ড করা হয়েছে অঙ্কিতিকে। তাঁর বিরুদ্ধে অবাধ্যতা, ঊর্ধবতনদের অনুমোদন ছাড়া সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো আরও অনেক অভিযোগ এনে শুরু হয়েছে তদন্তও। আর যাঁরা অঙ্কিতির বিরুদ্ধে এই সমস্ত অভিযোগকে মান্যতা দিয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই অঙ্কিতির কাছের মানুষ ছিলেন এক সময়ে।
যে সংস্থার জন্য অঙ্কিতির এই সাফল্য এবং ‘অপবাদ’ তার নাম জিলিঙ্গো। সিঙ্গাপুরের এই স্টার্ট আপ ফ্যাশন ই-কমার্স সংস্থা ফ্যাশন সামগ্রী বিক্রেতাদের বৃহত্তর বাজারে নিজেদের পণ্য বিক্রি করার সুযোগ করে দেয়। পরিষেবার বদলে নেয় কমিশন। এই ভাবনার পুরোটাই তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত বলে বহু সাক্ষাৎকারে বহুবার বলেছেন বাঙালি কন্যা। তবে যে কোনও বিষয় ভাবা আর করার মধ্যে অনেক তফাত থাকে। অঙ্কিতিকে সেই তফাত মেটাতে সাহায্য করেছিলেন বেঙ্গালুরুর এক প্রযুক্তিবিদ ধ্রুব কপূর।
ধ্রুব জিলিঙ্গোর সঙ্গে রয়েছেন তার জন্মলগ্ন থেকেই। অঙ্কিতি যখন সংস্থাটির বিপণণ এবং অন্য আর্থিক, বাণিজ্যিক দিত সামলাতে ব্যস্ত, তখন ধ্রুব পুরো প্রক্রিয়াটির প্রযুক্তিগত বিষয়ের দায়িত্বে ছিলেন। এমনকি অঙ্কিতির অবর্তমানে এখনও জিলিঙ্গোতেই রয়েছেন তিনি।
ধ্রুবর সঙ্গে অঙ্কিতির আলাপ সেই ২০১৫ সালে। এক পড়শির সঙ্গে অঙ্কিতির বাড়িতে এসেছিলেন ধ্রুব। দু’জনের কেউই কাউকে চিনতেন না। অঙ্কিতি তখন বেঙ্গালুরুর সিক্যুইয়া ক্যাপিটালের বড় পদে। তবে মাথায় ঘুরছে জিলিঙ্গোর ভাবনা। নতুন ব্যবসা শুরু করার জন্য খুঁজছেন এক জন প্রযুক্তিবিদকে। ধ্রুব ছিলেন একটি গেমিং সংস্থার প্রযুক্তিবিদ। অঙ্কিতি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন ধ্রুব তাঁর বাড়ির সোফায় বসে বসে বিয়ার হাতে নিয়ে নিজের প্রযুক্তির জ্ঞানের কথা বলছিলেন, শুনে অঙ্কিতি তাঁকে তাঁর সঙ্গে কাজ করার প্রস্তাব দেন।
সেই ধ্রুব সম্প্রতি জিলিঙ্গোর কর্মীদের একটি মেল পাঠিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে, ‘সংস্থা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর অনেকেই এই সংস্থা এবং কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে হেনস্তার অভিযোগ এনেছেন। আমি জানিয়ে দিতে চাই, এই সংস্থা কোনওরকম হেনস্তা বা কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্তার ঘটনাকে জিলিঙ্গো কখনও সহ্য করেনি, করবেও না। যদি কেউ সংস্থার সুনাম নষ্ট করতে চায়, তবে তাঁর বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ওই মেলে কোথাও অঙ্কিতির নাম উল্লেখ করা হয়নি। তবে যাঁরা অঙ্কিতি আর ধ্রুবকে কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁরা জানিয়েছেন, মেলটি অঙ্কিতির জন্যই। কারণ তিনিই সাসপেন্ড হওয়ার পর জিলিঙ্গোতে হেনস্তার অভিযোগ এনেছেন।
জিলিঙ্গোয় অঙ্কিতির ক্রমাগত উত্থানের আর এক সহযোগী ছিলেন শৈলেন্দ্র সিং। তিনি জিলিঙ্গোর মূল বিনিয়োগকারীদের একজন। সিক্যুইয়া ক্যাপিটালের মালিক। শোনা যায়, শৈলেন্দ্র ছিলেন অঙ্কিতির পৃষ্ঠপোষকদের অন্যতম। তাঁর জন্যই একটা জিলিঙ্গোর মুখ হয়ে উঠেছিলেন অঙ্কিতি। সংস্থাটির নাম বলতে তাঁকেই এক ডাকে চিনত সবাই। সম্প্রতি সেই শৈলেন্দ্রই জিলিঙ্গোর সিইও পদ থেকে সরে দাঁড়াতে বলেন অঙ্কিতিকে। এমনকি অঙ্কিতি যখন জিলিঙ্গোতে নিজের অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য লড়ছেন, তখন শৈলেন্দ্র ঘনিষ্ঠ মহলে ঘোষণা করে দিয়েছেন সংস্থার পরবর্তী সিইও-র নামও।
বাঙালি মেয়ে। তবে পড়াশোনা মুম্বইয়ে। সেন্ট জেভিয়ার্সের অঙ্ক আর অর্থনীতির মেধাবী ছাত্রী তিনি। উচ্চাকাঙ্ক্ষী। যদিও পরিশ্রমে কখনও কসুর রাখেননি অঙ্কিতি। আর কখনও লাগাম টানেননি তাঁর ভাবনায়। তা নাহলে ছুটিতে ব্যাঙ্ককে বেড়াতে গিয়ে স্রেফ ফ্যাশন সামগ্রীর খোলা বাজার দেখে কেউ ব্যবসার পরিকল্পনা ফেঁদে বসে! অথচ সেই ভাবনা থেকেই জিলিঙ্গোর সুতো বোনা শুরু।
তার পর সাত বছরে ‘সতেরো রকম’ সম্মান পেয়ছেন অঙ্কিতি। কখনও তিনি ফোর্বস তালিকায়, কখনও কমবয়সি বিলিওনেয়ারের তালিকায়, তাঁকে শিরোনামে রেখে, প্রচ্ছদ সাজিয়েছে বহু পত্রিকাও।
তেমনই এক পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অঙ্কিতি বলেছিলেন তিনি ভয় পান তাঁর মতো আরেকটি অঙ্কিতিকে। যে তাঁর মতোই বাজারে এসে সবাইকে মাত দিয়ে দেবে। ঠিক তাঁর মতো শত্রুকেই সবচেয়ে বেশি ভয় তাঁর। কিন্তু তখনও অঙ্কিতি জানতেন না ‘শত্রু’ তাঁর গোকুলে বাড়ছে তিনিই শুধু বুঝতে পারেননি।