তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ একাধিক। তাঁর বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছিল সিবিআই, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট (ইডি) থেকে এনআইএ-র মতো কেন্দ্রীয় সংস্থা। তবে প্রায় আট বছর ধরে সেই অভিযুক্ত বুকি অনিল জয়সিংঘানিকে ছুঁতেও পারেননি কোনও তদন্তকারী সংস্থা।
অবশেষে গত মার্চে ধরা পড়েন ১০ হাজার কোটির হাওয়ালা চক্রের কারবারি হিসাবে অভিযুক্ত অনিল। শুধু তিনিই নন। ধরা হয়েছে অনিলের ২৪ বছরের মেয়ে অনিক্ষা জয়সিংঘানি এবং তাঁর তুতো ভাই নির্মলকেও। যদিও অনিক্ষা এবং নির্মলের বিরুদ্ধে অন্য অভিযোগ রয়েছে।
হাওয়ালা কারবারে জড়িত থাকা ছাড়াও অনিলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, আইপিএলে বিপুল অর্থের বেটিং চক্রের সঙ্গে জড়িত তিনি। এ ছাড়া অনিল-সহ ওই তিন জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মহারাষ্ট্রের উপমুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা দেবেন্দ্র ফডণবীসের স্ত্রী অম্রুতাকে ব্ল্যাকমেল করেছেন তাঁরা।
অম্রুতাকে ব্ল্যাকমেল করতে গিয়ে তাঁর কাছ থেকে ১০ কোটি টাকা চেয়েছেন বলে অনিলের মেয়ে অনিক্ষার বিরুদ্ধে অভিযোগ। ইতিমধ্যেই তিন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ৭৯৩ পাতার চার্জশিট জমা দিয়েছেন মুম্বইয়ের মালাবার হিল থানার আধিকারিকেরা।
চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি একটি এফআইআরে মালাবার হিল থানার দাবি, বাবাকে একাধিক মামলা থেকে রেহাই দিতে অম্রুতাকে প্রথমে ১ কোটি টাকা ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন অনিক্ষা। তবে তাতে কাজ না হওয়ায় অন্য পন্থা নিয়েছিলেন তিনি।
পুলিশের চার্জশিটে অনিক্ষা এবং অনিলের সঙ্গে অম্রুতার মোবাইলের কথোপকথন তুলে ধরা হয়েছে। পুলিশের দাবি, অনিলকে পাকড়াও করতে তাদের অনুমতি নিয়েই চ্যাট চালিয়ে গিয়েছেন অম্রুতা।
তদন্তকারীদের সূত্রে খবর, ১০ হাজার কোটির একটি হাওয়ালা চক্রের তদন্তে নেমে এতে দুবাই এবং করাচির যোগসূত্র খুঁজে পান তাঁরা। সে সময় অনিলের নাম উঠে আসে। আইপিলে বেটিং চক্র চালনোর নেপথ্যেও তাঁর হাত রয়েছে বলে অভিযোগ।
অনিল নাকি অসংখ্য বুকির মাধ্যমে ওই বেটিং চক্রটি চালান। ব্রিটেনের একটি স্পোটর্স বেটিং ওয়েবাসাইটের হয়ে ওই বুকিরা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে জুয়ায় অর্থ ঢালেন। সে জন্য কাজে লাগানো হয় ব্রিটেন-সহ ইউরোপে পাঠরত ভারতীয় এবং পাকিস্তানি পড়ুয়াদের।
সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, ৫৬ বছরের অনিলকে পাকড়াও করতে গত মাসের গোড়ায় নানা জায়গায় তল্লাশি চালিয়েছেন ইডির আমদাবাদ ইউনিটের সদস্যরা। ঠাণের উল্লাসনগরে তাঁর বাড়ি ছাড়াও সিরডির একটি হোটেলে হানা দেন তাঁরা।
ইডি সূত্রে দাবি, তল্লাশি অভিযানে নেমে একাধিক হোটেল, ফ্ল্যাট, দোকান, জমিজমা-সহ স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে অনিলের ১০০ কোটির সম্পত্তির হদিস পাওয়া গিয়েছে। অনিল ছাড়াও তাঁর সন্তান, আত্মীয়স্বজন এবং ঘনিষ্ঠদের নামে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের খোঁজ মেলে।
তদন্তকারীদের সূত্রে অভিযোগ, দাউদ ইব্রাহিমের অঙ্গুলিহেলনেই হাওয়ালা থেকে শুরু করে আইপিএলে বেটিং চক্রে জড়িত অনিল। আইপিএলে বেটিংয়ের অভিযোগে তাঁর দিকে নজর ছিল ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের দুর্নীতি বিরোধী এবং নিরাপত্তা ইউনিট (এসিএসইউ)-এর।
অনিলের বিরুদ্ধে অন্তত ১৭টি মামলা ঝুলছিল। তাঁকে খুঁজছিল অন্তত পাঁচটি রাজ্যের পুলিশ। অবশেষে ২০ মার্চ অনিলকে গ্রেফতার করে ইডি। কী ভাবে জালে পড়লেন তিনি?
সংবাদমাধ্যমের কাছে মালাবার হিল থানার আধিকারিকেরা জানিয়েছিলেন, মূলত অম্রুতার সঙ্গে চ্যাটের সূত্র ধরেই অনিলের খোঁজ পাওয়া সম্ভব হয়েছে।
সেই কথোপকথন কিছু অংশ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করেছে ইডি। ২২ ফেব্রুয়ারি অনিলের সঙ্গে কথোপকথনের সময় অম্রুতা বলেছেন, ‘‘আপনাকে ফাঁসানো হলে আমি দেবেন্দ্রজি (ফডণবীস)-র সঙ্গে কথা বলতে পারি যাতে সুবিচার পান। তবে অনিক্ষার দাবি মেনে নেব না। আমি কোনও দোষ করিনি, তা জানি। আপনি এবং অনিক্ষা ব্ল্যাকমেল করার জন্য গোড়া থেকে চেষ্টা করছেন।’’
কী হুমকি দিয়ে ব্ল্যাকমেল করছিলেন অনিলেরা? ইডির দাবি, গোড়ায় অম্রুতাকে ১ কোটি টাকা ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন। তবে অম্রুতা তাতে রাজি না হওয়ায় তাঁকে ব্ল্যাকমেল করা শুরু করেন। অম্রুতাকে ফাঁসাতে কয়েকটি ভিডিয়োও তৈরি করেন তাঁরা। তাতে দেখা গিয়েছে, ১ কোটি টাকার নগদ ভর্তি একটি ব্যাগের ছবি। অন্য একটি মোবাইল নম্বর থেকে সেটি অম্রুতাকে পাঠানো হয়েছিল।
সংবাদ সংস্থা পিটিআই সূত্রে খবর, অম্রুতাকে ফোন করে অনিক্ষা দাবি করেন, ওই ভিডিয়ো ক্লিপটি প্রকাশ্যে এলে ফডণবীসের বিরুদ্ধে বড়সড় রাজনৈতিক হাঙ্গামা হবে।
ইডির চার্জশিট অনুযায়ী, অম্রুতাকে একটি বার্তায় অনিক্ষা বলেছেন, ‘‘প্রিয় দিদিজি, আপনি আমার সঙ্গে কথা বললে তা দু’পক্ষেরই কাজে আসবে। আমায় ১০ কোটি টাকা দিন, আমার বাবাকে পুলিশ কেসের থেকে বাঁচান। কথা দিচ্ছি, আপনাকে সমস্ত অডিয়ো-ভিডিয়ো দিয়ে দেব।’’
ইডির সূত্রের দাবি, অনিক্ষার ওই বার্তার উত্তরে অম্রুতা বলেছেন, ‘‘(অডিয়ো-ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এলে) কিছু দিনের জন্য হয়তো আমার বদনাম হতে পারে। তবে সত্য প্রকাশ্যে আসবেই। ফলে এতে আমার কিছু যায়-আসে না।’’
ইডির নির্দেশেই নাকি অনিলের সঙ্গে কথোপকথন চালিয়েছেন অম্রুতা। এমনকি, স্বামীর সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক নেই, এমন বলারও নির্দেশ দিয়েছিলেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি অনিলের সঙ্গে একটি চ্যাটে অম্রুতা বলেছেন, ‘‘মোবাইলে কথা বলার চেয়ে অনিক্ষার সঙ্গে দেখা করব আমি। আপনার বিরুদ্ধে মামলাগুলি কী কী, সে সম্পর্কে জেনে নিয়ে দেবেন্দ্রজির সঙ্গে কথা বলব। অনিক্ষার সঙ্গে (ফেব্রুয়ারির) ২৬ তারিখ দেখা করতে পারি। কারণ, ২৬ তারিখ পর্যন্ত দেবেন্দ্রজি পুণের উপনির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন।’’
এর পর একটি বার্তায় দেবেন্দ্র-পত্নী অনিলকে বলেছেন, ‘‘২০১৯ সাল থেকে আমাদের মধ্যে ভাল সম্পর্ক নেই। মনে হচ্ছে, তিনি আমাকে ডিভোর্স দিতে পারেন। তবে একটা বিষয় জানি যে, আপনাকে ফাঁসানো হলে আপনি যাতে সুবিচার পান, তা দেখবেন তিনি।’’
এই কথোপকথনের কয়েক দিন পরেই অনিলকে গ্রেফতার করে ইডি। তাদের দাবি, মোবাইল লোকেশনের সূত্র ধরেই হদিস মেলে অনিলের। নিজেদের চার্জশিটে অম্রুতার সঙ্গে অনিল এবং তাঁর মেয়ের হোয়াট্সঅ্যাপ চ্যাটের স্ক্রিনশটও যুক্ত করেছে ইডি।