একটা ডিফেন্স চেরা পাস। সেখান থেকে গোল করে বিশ্বকাপ জয়। এ হেন ট্রফি জেতার কারিগরকে নিয়ে যে দুনিয়া জুড়ে হইচই চলবে, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু, সে সবে আমলই দিলেন না তিনি। ৩০ বছরে পা দেওয়ার আগেই তুলে রাখলেন বুট জোড়া। কারণ তত দিনে রক্তে চেপে বসেছে অ্যাডভেঞ্চারের নেশা। খাড়াই পাহাড়ে হাইকিং আর বরফে ঢাকা পাহাড়চূড়া জয় করেই দিন কাটছে প্রাক্তন তরুণ ফুটবলারের।
তিনি, আন্দ্রে হর্স্ট শুর্লে। ২০১৪ সালের ফিফা বিশ্বকাপজয়ী জার্মান দলের অন্যতম সদস্য। মাত্র ২৯ বছর বয়সে ফুটবলকে বিদায় জানিয়ে একেবারে নতুন জীবন শুরু করেছেন এই খেলোয়াড়। বর্তমানে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয়ের পরিকল্পনা করেছেন তিনি।
২০২০ সালের জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় জানান শুর্লে। এর পরই শুরু করেন হাইকিং ও পর্বতারোহণ। ফুটবল ছাড়ার পর পরই অবশ্য বার্সেলোনা ম্যারাথনে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। সেখানে বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ৪৪ কিলোমিটার দৌড়তে দেখা গিয়েছিল তাঁকে।
হাইকিং ও পর্বতারোহণ মিলিয়ে মোট ১৫০টি অভিযানে অংশ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছেন এই প্রাক্তন জার্মান ফুটবলার। যার মধ্যে এখনও পর্যন্ত ১১০টি শৃঙ্গ জয় করতে পেরেছেন তিনি।
নিজের নতুন জীবনের প্রতিচ্ছবি ইনস্টাগ্রাম চ্যানেলে তুলে ধরেছেন শুর্লে। তাতে ব্যর্থতা ও সেখান থেকে ফিরে আসার কথাও বলতে শোনা গিয়েছে তাঁকে। সমাজমাধ্যমে জার্মান ফরোয়ার্ড ও উইঙ্গার লিখেছেন, “ব্যর্থ! আমি লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি। এখন বড় হয়েছি। আরও অনেক কিছু করতে পারছি। ভাল প্রশিক্ষণ পেয়েছি। ফলে মানসিক ভাবেও অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছি।”
ইনস্টাগ্রামে তাঁর সফল অভিযানের একাধিক ছবি পোস্ট করেছেন এই জার্মান উইঙ্গার। সেখানে পিঠে ব্যাগ নিয়ে তাঁকে হাইকিং করতে দেখা গিয়েছে। শুধু তাই নয়, হিমাঙ্কের ১৯ ডিগ্রি নীচের তাপমাত্রায় খালি গায়ে পাহাড়চূড়ায় উঠেছেন তিনি। সেই অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে শুর্লে লিখেছেন, “সবচেয়ে কঠিন মানসিক ও শারীরিক একটা কাজ করলাম।”
সম্প্রতি, জার্মানির সর্বোচ্চ পর্বত জুগস্পিটজ়ের মাথায় ওঠেন বিশ্বকাপজয়ী এই ফুটবলার। সমুদ্রতল থেকে যার উচ্চতা তিন হাজার মিটার। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কয়েক জন বন্ধুর সঙ্গে বরফের মধ্যে খালি গায়ে ঘুরতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। দু’টি ঘটনারই ভিডিয়ো ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেন শুর্লে।
উল্লেখ্য, গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ থেকে পর্বতারোহণ ও হাইকিং শুরু করেছেন প্রাক্তন জার্মান খেলোয়াড়। এ বছর এখনও পর্যন্ত চার হাজার মিটারের বেশি উচ্চতার চারটি শৃঙ্গ জয় করেছেন তিনি। সেগুলি হল, স্লোভানিয়ার ট্রিগ্লাভ, ইটালির গ্রান প্যারাডিসো, সুইৎজ়ারল্যান্ডের ডুফোরস্পিটজে ও ফ্রান্সের মঁ ব্লা।
পর্বতারোহণ ও হাইকিংয়ের জন্য নিজেকে তৈরি করতে একাধিক ম্যারাথনে অংশ নেন শুর্লে। গত বছর (২০২৩) বার্সেলোনা ম্যারাথন শেষ করতে চার ঘণ্টা সময় লেগেছিল তাঁর। পরবর্তী কালে ইটালির চিয়ান্টি ম্যারাথনে অংশ নিতেও দেখা গিয়েছে তাঁকে।
শুর্লে ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, আগামিদিনে এভারেস্ট জয়ের লক্ষ্যে ৮ হাজার ৮৪৮ মিটারের খাড়াই হাইকিং করবেন তিনি। ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে পুরো অভিযান শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। যদিও সেই হাইকিং কবে থেকে শুরু হবে, তা স্পষ্ট করেননি জার্মান উইঙ্গার।
এভারেস্ট অভিযান শুরুর আগে ইনস্টাগ্রামে তাৎপর্যপূর্ণ ভিডিয়ো পোস্ট করেছেন শুর্লে। সেখানে হলিউডের জনপ্রিয় শাটার দ্বীপের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, “কোনটা ঠিক? দানব হয়ে বেঁচে থাকা, না কি ভাল মানুষ হয়ে মরে যাওয়া?”
শুর্লের জন্ম জার্মানির লুডউইগশাফেনে। তারিখটা ছিল ১৯৯০ সালের ৬ নভেম্বর। মাত্র ৪ বছর বয়সে স্থানীয় ফুটবল ক্লাবে খেলা শুরু করেন তিনি। গতি বাড়িয়ে আক্রমণে উঠে আসা বা পায়ের জাদুতে মাঝমাঠে ফুল ফোটানো— স্পটারদের চোখে পড়তে খুব একটা সময় লাগেনি তাঁর।
২০০৯ সালে পেশাদার খেলোয়াড় হিসাবে ফুটবলের দুনিয়ায় ঢুকে পড়েন শুর্লে। জার্মান ক্লাব মেইনজ় ০৫-এ খেলা শুরু করেন তিনি। সেখানে বছর দুই কাটিয়ে চলে যান বায়ার ০৪ লেভারকুশেনে। এর পর আর তাঁকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
২০১৩ সালে ব্রিটিশ ক্লাব চেলসিতে যোগ দেন শুর্লে। ২০১৫ সালে ফের ফিরে আসেন নিজের দেশের ক্লাব ভিএফএল উল্ফসবার্গে। সেখানে প্রথম বছরেই ডিএফবি পোকাল ও ডিএফএল সুপার কাপ জেতেন তিনি।
২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত জার্মান জাতীয় দলে নিয়মিত খেলেছেন শুর্লে। তৎকালীন কোচ জোয়াকিম লো-র পছন্দের খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক কেরিয়ারে মোট ৫৭টি ট্রফি জিতেছেন এই ফুটবলার। করেছেন ২২টি গোল।
২০১৪ সালের ফিফা বিশ্বকাপে স্বপ্নের ফর্মে ছিলে আন্দ্রে শুর্লে। সেমিফাইনালে পরিবর্ত খেলোয়াড় হিসাবে নেমে ব্রাজ়িলের বিরুদ্ধে দৃষ্টিনন্দন গোল করেন তিনি। ওই ম্যাচে ৭-১ গোলে জিতেছিল জার্মানি।
ওই বিশ্বকাপের ফাইনালে অতিরিক্ত সময়ে তাঁর বাড়ানো বল জালে জড়িয়ে দেন সতীর্থ ফুটবলার মারিও গোৎসে। ১১৩ মিনিটের মাথায় সোনালি পাসটি দিয়েছিলেন শুর্লে। ম্যাচে আর্জেন্টিনার কফিনে সেটাই ছিল শেষ পেরেক।