আজ যেখানে বরফের চাদর, এক কালে সেখানে ছিল একাধিক নদী, উপত্যকা, এমনকি গভীর জঙ্গল। এমনটাই বলছেন এক দল গবেষক। তার পরেই বিগত কয়েক বছরের গবেষণা প্রশ্নের মুখে।
মাইলের পর মাইল বরফে ঢাকা। সবুজের প্রায় কোনও চিহ্ন নেই। এ হেন আন্টার্কটিকায় এক কালে ছিল না বরফের স্তর। এমনটাই দাবি করেছে গবেষণা।
গবেষণাটি চালিয়েছে ব্রিটেনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল। উপগ্রহের সংগৃহীত তথ্য এবং রেডিয়ো-ইকো শব্দ প্রযুক্তির মাধ্যমে বরফের চাদরে ঢাকা ৩২ হাজার বর্গ কিলোমিটার জায়গায় গবেষণা চালিয়েছিল দলটি।
ভারত মহাসাগর সংলগ্ন পূর্ব আন্টার্কটিকার উইলকিস ল্যান্ড অঞ্চলে এই গবেষণা চালানো হয়েছে। বেলজিয়ামের সমান সেই এলাকায় না কি এককালে ছিল নদী, জঙ্গল, শৈলশিরা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ওই অঞ্চলেই বাঁধা পড়ে রয়েছে কোটি কোটি বছরের পুরনো অতীত।
পূর্ব আন্টার্কটিকার ওই অঞ্চলের ভূমিরূপ খতিয়ে দেখেছে দলটি। ভূমির গঠনও পরীক্ষা করা হয়েছে। তাতেই দেখা গিয়েছে, আন্টার্কটিকার ভূমিরূপ গঠন করেছে নদী। আর তা হয়েছে প্রায় এক কোটি ৪০ লক্ষ বছর আগে।
অর্থাৎ এখন যেখানে আন্টার্কটিকা, সেখানে প্রায় দেড় কোটি বছর আগে প্রবাহিত হত নদী। সেই নদীবাহিত পলি, বালি দিয়েই গঠিত হয়েছিল আন্টার্কটিকার ভূমিরূপ। পূর্ব আন্টার্কটিকায় না কি কাজটা শুরু হয়েছিল তিন কোটি ৪০ লক্ষ বছর আগে।
গবেষক দল জানিয়েছে, বরফ ঢাকা আন্টার্কটিকার এক সময় ছিল উপত্যকা, শৈলশিরা। তার স্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে। ব্রিটেনের উত্তর ওয়েলসে যে ধরনের ভূমিরূপ দেখা যায়, তার সঙ্গে আন্টার্কটিকার ভূমিরূপের মিল রয়েছে।
ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক স্টুয়ার্ট জেমিসন জানিয়েছেন, মঙ্গলের ভূমিরূপ নিয়ে যত গবেষণা হয়েছে, আন্টার্কটিকার ভূমিরূপ নিয়ে তার থেকে অনেক কম গবেষণা হয়েছে। তাই এই বিষয়ে অনেক কম তথ্য রয়েছে।
স্টুয়ার্ট মনে করেন, বিগত বছর ধরে আন্টার্কটিকার ভূমিরূপের খুব একটা বদল হয়নি। মনে করা হয়, অতীতে এই অঞ্চলের বরফের স্তর গলে যেত।
ব্রিটেনের নিউ কাস্ল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিল রস জানিয়েছেন, বছরের পর বছর আন্টার্কটিকার এই ভূমিরূপ সাধারণ মানুষ, অভিযানকারীদের চোখের আড়ালে ছিল। অথচ পূর্ব আন্টার্কটিকার এই অংশই অতীত ইতিহাসের কথা তুলে ধরেছে। ভবিষ্যতে জলবায়ু কী ভাবে পরিবর্তিত হবে, তারও ইঙ্গিত দিয়েছে এই ভূমিরূপ।
গবেষণায় জানা গিয়েছে, পূর্ব আন্টার্কটিকায় এক কালে ছিল পর্বতশ্রেণি, খাড়ি এমনকি হ্রদও। সে সব এখন বরফের নীচে। আরও অনেক কিছুই ছিল আন্টার্কটিকায়। গবেষকেরা জানিয়েছেন, এখনও সব আবিষ্কার করা যায়নি।
রস জানিয়েছেন, এখন আন্টার্কটিকা ২.২ থেকে ৩ কিলোমিটার বরফের চাদরে ঢাকা। সেই চাদর সরিয়ে অনেক কিছুরই খোঁজ চালানো সম্ভব নয়। কোটি বছর আগে আন্টার্কটিকায় কী ধরনের প্রাণী বাস করত, তা-ও জানা সম্ভব হয়নি এখনও।
গবেষকেরা পুরু বরফের চাদর সরিয়ে আন্টার্কটিকার মাটি সংগ্রহ করে তার পরীক্ষা চালানোর চেষ্টা করছেন। তা সম্ভব হলে অনেক কিছুই জানা যাবে। দীর্ঘ সময় ধরে বরফাবৃত আন্টার্কটিকার ভূমিরূপের ছবি তুলেছে উপগ্রহ। সেই চিত্র থেকেই আঁচ মিলেছে বরফে ঢাকা প্রকৃত ভূমিরূপের।
বিজ্ঞানী রস জানিয়েছেন, এখন নিউ জিল্যান্ডের তাসমানিয়ার নাতিশীতোষ্ণ বৃষ্টি অরণ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকার প্যাটাগোনিয়ায় যে ধরনের ভূমিরূপ এবং ছোট উদ্ভিদ দেখা দেয়, ৩ কোটি ৪০ লক্ষ বছর আগে আন্টার্কটিকার ভূমিরূপ ছিল সে রকমই। তখন সে রকমই উদ্ভিদ জন্মাত সেখানে।
কোটি বছর আগে আন্টার্কটিকা, বর্তমানের আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ভারতীয় উপমহাদেশ, আরব উপদ্বীপ একই ভূখণ্ডে অবস্থিত ছিল। প্লেট টেকটনিক তত্ত্ব মেনে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল সেই সব ভূখণ্ড। সে কারণে এই অঞ্চলের ভূমিরূপে মিল থাকা অস্বাভাবিক নয় বলেই মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানী জেমিসনের মতে, অতীতে যখন আন্টার্কটিকার তাপমাত্রা তুলনামূলক বেশি ছিল, তখন সেখান দিয়ে উপকূলের দিকে বয়ে চলত নদী। ক্রমে ওই অঞ্চলের তাপমাত্রা কমতে থাকলে নদীগুলি হিমবাহে পরিণত হতে থাকে। কিছু হিমবাহ ক্ষয় পাওয়ার কারণে আরও গভীর হয়েছে উপত্যকা।
ক্রমেই আন্টার্কটিকার উষ্ণতা কমতে থাকে। তার উপর জমতে থাকে বরফের চাদর। তিন কোটি ৪০ লক্ষ বছর ধরে সেই বরফের চাদরের নীচে অক্ষত অবস্থায় রয়েছে আন্টার্কটিকার ভূমি। সেই ভূমিই এখন খুঁড়ে বার করার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা।