২৫ হেক্টর এলাকা। তার উপর গড়ে উঠেছে ‘ভিলা লরেনা’। সেখানেই ৯০০ সন্তান-সন্ততিকে নিয়ে বাস করেন অ্যানা জুলিয়া টরেস। সকল সন্তান-সন্ততিই চতুষ্পদ। ক্যালিফোর্নিয়ার ক্যালি শহরে অ্যানার এই আস্তানায় গেলে দেখা যায়, ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে সিংহ-হাতির দল। বাড়িতে পোষা বাঁদর থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর দেখা মিলবে ‘ভিলা লরেনা’য়।
অ্যানা প্রচারে আসেন তাঁর সঙ্গে ‘জুপিটার’-এর সম্পর্কের কথা প্রকাশ্যে আসার পর। সার্কাস থেকে জুপিটার নামের একটি সিংহকে উদ্ধার করেছিলেন অ্যানা। তখন জুপিটারের ৩ বছর বয়স। অ্যানা এবং জুপিটারের যখন সাক্ষাৎ হয় তখন জুপিটারের অবস্থা শোচনীয়। তার থাবার একাংশ উপড়ে ফেলা হয়েছে, শরীরে রয়েছে আঘাতের চিহ্ন। জুপিটারকে এমন অবস্থায় দেখে তাকে উদ্ধার করে নিজের কাছে নিয়ে আসেন অ্যানা।
ক্রমেই গাঢ় হতে থাকে অ্যানা এবং জুপিটারের বন্ধুত্ব। জুপিটারকে দত্তক নিয়েছিলেন অ্যানা। নিজের হাতে জুপিটারকে খাইয়ে দিতেন তিনি। বাড়ির অন্য পোষ্যদের মতোই আচরণ করত জুপিটার। দেখতে দেখতে কখন যে ষোলো বছর কেটে গেল, তা বুঝতেই পারেননি অ্যানা।
জুপিটার এবং অ্যানার বন্ধুত্বে ছেদ পড়ে ষোলো বছর পর। পরিবেশ দফতরের আধিকারিকেরা অ্যানার ভিলা পরিদর্শনে আসেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন যে, এমন পরিবেশ সিংহদের বেড়ে ওঠার পক্ষে উপযুক্ত নয়। তার জন্য আরও মুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন। জুপিটারকে তাই নিজেদের সঙ্গে নিয়ে চলে যান তাঁরা।
তিন-চার বছর পর জুপিটারের সঙ্গে দেখা করতে যান অ্যানা। কিন্তু জুপিটারের অবস্থা দেখে কেঁদে ওঠেন তিনি। জুপিটারের সঙ্গে যখন তাঁর শেষ দেখা হয়েছিল, তখন তার ওজন ছিল ২৫০ কেজি। সেই জুপিটারের সঙ্গে এখনকার জুপিটারের কোনও মিলই নেই। জুপিটারের ওজন কমে দাঁড়িয়েছে ৯০ কেজিতে।
জুপিটার এত দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে, তার উঠে বসার মতো ক্ষমতাও ছিল না। এমনকি, অ্যানাকেও চিনতে পারছিল না সে। অ্যানা আর নিজেকে সামলাতে পারেননি। এই বিষয়টি নিয়ে তিনি গণমাধ্যমের সাহায্য নেন এবং জুপিটারকে নিজের কাছে ফিরিয়ে আনেন। অ্যানার কাছে সেবা-শুশ্রূষা পাওয়ার পর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে শুরু করে জুপিটার।
আবার আগের মতো স্বাভাবিক খাওয়াদাওয়া করতে থাকে জুপিটার। অ্যানাকেও চিনতে পারে সে। দু’জনে আবার তাদের হারানো বন্ধুকে ফিরে পায়। কিন্তু এই সুখ বেশি দিন ভোগ করতে পারেননি কেউই। জুপিটারকে বাড়ি নিয়ে আসার দু’সপ্তাহ পর মারা যায় সে। ২০ বছর বয়সি জুপিটারের মৃত্যু এখনও ভুলতে পারেননি অ্যানা।
পশুপাখিদের প্রতি অ্যানার ভালবাসার সূত্রপাত পেশাগত কারণে। ২২ বছর আগে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। প্রতি মুহূর্তে অ্যানা তাঁর ছাত্রছাত্রীদের প্রকৃতিকে ভালবাসতে বলতেন। এক দিন হঠাৎ পড়াতে পড়াতে তিনি তাঁর ছাত্রছাত্রীদের বলেন, ‘‘তোমাদের যাদের বাড়িতে পোষ্য রয়েছে, তারা সকলেই পরের দিন স্কুলে নিজেদের পোষ্যকে নিয়ে আসবে। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে।’’
ছাত্রছাত্রীরা যখন ক্লাসে তাদের পোষ্যদের নিয়ে আসে, তখন অ্যানা বুঝতে পারেন, কত রকমের প্রাণীকে পোষ মানানো যায়। তার কয়েক মাস পর অ্যানার এক বন্ধু তাঁকে একটি প্যাঁচা উপহার দেন। বেআইনি ভাবে ওই প্যাঁচাটি কিনেছিলেন অ্যানার বন্ধু। কিন্তু প্যাঁচাটিকে নিয়ে বিরক্ত হয়ে যান তিনি। অ্যানা পশুপাখি ভালবাসেন জেনে তাঁর কাছে নিজের পোষ্যকে নিয়ে আসেন ওই বন্ধু।
অ্যানা ভাবেন, তাঁর বন্ধুর মতো এমন অনেকেই রয়েছেন যাঁরা নিজেদের পোষ্যকে আর রাখতে চান না। কেউ কেউ আবার পোষ্যদের মারধরও করেন। তাঁদের হাত থেকে পোষ্যদের উদ্ধার করার সিদ্ধান্ত নেন অ্যানা। কিন্তু এত পশুপাখি একসঙ্গে কোথায় রাখবেন তিনি? ক্যালি শহরে কম দামে একটি জমির খোঁজ পান অ্যানা। পশুপাখিদের আশ্রয়ের জন্য সেই জমি কিনেও ফেলেন তিনি। গড়ে ওঠে ‘ভিলা লরেনা’।
অ্যানা জানতেন যে, সার্কাসের তাঁবুতেই পশুপাখিদের উপর সবচেয়ে বেশি অত্যাচার করা হয়। তাই তিনি সার্কাসের তাঁবুগুলিতে খোঁজ করতে শুরু করেন। তাঁর এই ভাবনাকে সকলে সম্মতিও জানান। হঠাৎ ‘ইয়েয়ো’ নামের একটি বাঁদরের খোঁজ পান তিনি। তার মালিক নাকি সারা দিন মদ্যপান করতেন। মারধরও করতেন ইয়েয়োকে। খবর পেয়ে দ্রুত ইয়েয়োকে উদ্ধার করতে চলে যান অ্যানা।
ইয়েয়োর সঙ্গে দেখা করার পর অ্যানা লক্ষ করেন যে, তার সারা গায়ে রক্তের দাগ, আঘাতের চিহ্ন। প্রতিবেশীরাও অ্যানার কাছে অভিযোগ করেন যে, প্রতি রাতেই বাড়ি থেকে বাঁদরটির কান্নার আওয়াজ শুনতে পান তাঁরা। অ্যানা পুলিশের কাছে পোষ্যের মালিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। তদন্তে জানা যায়, মালিক মদ্যপান করার পর বাঁদরটিকে অনবরত লাথি মারতেন। শেষ পর্যন্ত ইয়েয়োকে উদ্ধার করে নিজের কাছে নিয়ে আসেন অ্যানা।
সার্কাসের তাঁবু থেকে একটি হাতিও উদ্ধার করেছিলেন অ্যানা। সার্কাসের পশুপাখি পরিদর্শনে এসে অ্যানা লক্ষ করেন যে, একটি হাতির লেজ কাটা, পা ক্ষতবিক্ষত, এমনকি একটি চোখও নষ্ট। অ্যানা ওই হাতিটিকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলেও সার্কাস কর্তৃপক্ষ রাজি হচ্ছিলেন না।
অ্যানা তার পর চেনাপরিচিত বন্ধুদের নিয়ে সার্কাসের তাঁবুর সামনে ধর্নায় বসেন। একটানা ধর্নায় বসার পর সার্কাস কর্তৃপক্ষে শেষ পর্যন্ত অ্যানার প্রস্তাবে রাজি হন। হাতিটিকে যখন সার্কাসের তাঁবুর ভিতর থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়, তখন হাতিটি তার শুঁড় দিয়ে অ্যানাকে জড়িয়ে ধরে। ওই হাতিটিকেও ক্যালিফোর্নিয়ায় নিয়ে আসেন অ্যানা।
এখনও ক্যালিফোর্নিয়ার ‘ভিলা লরেনা’য় আসে বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি। সকলকে নিয়ে সুখের সংসার গড়ে তুললেও অ্যানার জীবন ‘জুপিটার’-এর স্মৃতিতে-আদরে মেখে রয়েছে।