এককালে তাঁর আয় ছিল মাসে ৫০০ টাকা। তবে আজকাল একটি ছবিতে মুখ দেখানোর জন্য নাকি অন্তত ৬ কোটি টাকার দর হাঁকান অমিতাভ বচ্চন। এক-একটি পণ্যের বিজ্ঞাপনী প্রচারের জন্য নাকি কোটি কোটি করে মেলে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সংবাদমাধ্যমের দাবি ছিল, ৩৩৯০ কোটি টাকার মালিক তিনি। তবে এককালে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলেন অমিতাভ বচ্চন।
সত্তর-আশির দশকে অমিতাভের কাঁধে ভর দিয়ে বহু সিনেমার তরী তীরে ভিড়েছিল। ফরাসি পরিচালক ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর সেই ‘ওয়ান ম্যান ইন্ডাস্ট্রি’ অমিতাভের ঘাড়ে বিপুল ঋণের বোঝা চেপে বসেছিল।
নব্বইয়ের দশকে অভিনয়ের পাশাপাশি ইভেন্ট ম্যানেজ়মেন্ট, সিনেমা তৈরি করা ছাড়া ডিস্ট্রিবিউশনের কাজেও মন দিয়েছিলেন অমিতাভ। ১৯৯৬ সালে যাত্রা শুরু করেছিল তাঁর সংস্থা অমিতাভ বচ্চন কর্পোরেশন (এবিসিএল)।
যাত্রা শুরুর বছর তিনেকের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়েছিল অমিতাভের সাধের এবিসিএল। আর্থিক দুর্দশায় পড়েছিলেন খোদ অমিতাভ। একে ৯০ কোটির দেনার বোঝা, তায় মামলা ঝুলছিল ৫৫টি। হাতে কোনও ছবি না থাকায় আয়ের পথও প্রায় বন্ধ।
সেই অন্ধকারময় পর্বে নিজের দুরবস্থার কথা সংবাদমাধ্যমের কাছে খোলসা করেছেন অমিতাভ। ২০১৭ সালে ‘ব্রুট ইন্ডিয়া’র ইউটিউব চ্যানেলে তিনি বলেছিলেন, ‘‘জীবনের এমন এক সময় এসেছিল যখন দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলাম।’’
অমিতাভের কণ্ঠে ছিল আবেগের ছোঁয়া। বলেছিলেন, ‘‘কোটি কোটি টাকা দেনার দায় চেপেছিল। আয়ের সমস্ত দরজা বন্ধ। নিজের ব্যাঙ্ক ব্যালান্স শূন্যে নেমে গিয়েছিল।’’
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি, এবিসিএলে চরম অব্যবস্থার জেরেই সংস্থার ঘাড়ে বিপুল ঋণের বোঝা চেপে বসেছিল। সিইও সঞ্জীব গুপ্তর কাঁধেও সে দায় বর্তায়। অথচ এককালে ‘দেখ ভাই দেখ’-এর মতো জনপ্রিয় ধারাবাহিক তৈরি করেছিল এবিসিএল।
টেলিভিশনের জন্য ধারাবাহিক ছাড়াও ‘অক্স’ থেকে ‘সরকার ৩’, সব মিলিয়ে ১৭টি সিনেমাও তৈরি করেছিল অমিতাভের সংস্থাটি। এ ছাড়া, ২টি বলিউডি সিনেমা পরিবেশনও করেছিল এবিসিএল। ’৯৬-এর সৌন্দর্য প্রতিযোগিতারও আয়োজক ছিল।
গোড়ায় রমরমিয়ে চললেও ক্রমাগত লোকসানের জেরে ১৯৯৯ সালে এবিসিএলের রুগ্ণ চেহারা বেরিয়ে পড়েছিল। অমিতাভ বলেছিলেন, ‘‘কোনও সন্দেহ নেই, আমার পেশাদার কেরিয়ারের সবচেয়ে অন্ধকারময় পর্ব ছিল সেই দিনগুলো। কখনও ভুলব না, পাওনাদারের আমাদের দরজায় এসে গালিগালাজ করতেন, হুমকি দিতেন, টাকাপয়সা ফেরত দেওয়ার কথা শোনাতেন।’’
তার প্রভাব পড়েছিল অমিতাভের সংসারেও। সে সময় আমেরিকার বস্টনে পড়াশোনায় ব্যস্ত ছিলেন ছেলে অভিষেক। পরে সংবাদমাধ্যমে তিনি বলেছিলেন, ‘‘কলেজ থেকে বাবার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। সে সময় আর্থিক দুর্দশার মধ্যে ছিলেন বাবা। শিক্ষাগত যোগ্যতার বিচারে ওই সময় অভিজ্ঞ না হলেও ছেলে হিসাবে বাবার পাশে দাঁড়ানো জরুরি ছিল। সেটা মানসিক ভাবে হলেও... ।’’
অভিষেক আরও বলেছিলেন, ‘‘কী ভাবে অন্ন জুটবে, সে চিন্তাও চেপে বসেছিল বাবার উপর। ওই সময় আমি তো আর বস্টনে বসে থাকতে পারছিলাম না! নিজেদের কর্মচারীদের থেকেও ধার নিতে হয়েছিল। বাবাকে ফোন করে বলেছিলাম, তোমার পাশে থাকতে, যে কোনও ভাবে সাহায্য করার জন্য কলেজের পড়াশোনা মাঝপথে ছেড়ে দেশে ফিরে যেতে চাই।’’
অভিষেকের ইচ্ছাপূরণ না হলেও অমিতাভের ঋণের বোঝা নেমে গিয়েছিল। ঋণের বোঝা নামাতে পরিচালক যশ চোপড়ার দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। যাতে যশের কোনও একটি ছবিতে তাঁকে সুযোগ দেন।
অমিতাভ বলেছিলেন, ‘‘সে দিনগুলোয় আমার কাছে কী কী পথ খোলা রয়েছে, তা বাছবিচার করতে বসেছিলাম। এক বার যশ’জির কাছে চলে গিয়েছিলাম। আমার বাড়ির পিছনেই ওঁর বাড়ি। কাজ দেওয়ার জন্য ওঁর কাছে অনুনয়-বিনয়ও করেছিলাম।’’
অমিতাভের অনুরোধ রেখেছিলেন যশ। ছেলে আদিত্য চোপড়ার পরিচালনায় একাধিক তারকার সঙ্গে অমিতাভকে দেখা গিয়েছিল ‘মহব্বতেঁ’-এর নারায়ণ শঙ্করের ভূমিকায়। তত দিন ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’-র মতো বাণিজ্যসফল ছবি তৈরি করে ফেলেছেন আদিত্য।
যশ চোপড়া ছাড়াও অমিতাভের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন শিল্পপতি ধীরুভাই অম্বানী। যদিও সে কথা যাতে অমিতাভের কানে না পৌঁছয়, সে চেষ্টাও নাকি করেছিলেন তিনি। অমিতাভ বলেছিলেন, ‘‘আমার দুর্দশার কথা জেনে কাউকে কিছু না জানিয়ে ছেলে অনিলকে বলেছিলেন, ‘ওর দুঃসময় চলছে। কিছু অর্থসাহায্য কোরো।’ ’’
ধীরুভাই সাহায্যের হাত বাড়ালে তাতে সুরাহা হত বলে জানিয়েছিলেন অমিতাভ। তাঁর কথায়, ‘‘তিনি (ধীরুভাই) যে অর্থসাহায্য করতেন, তাতে তাঁর সব সমস্যার সমাধান হত । তবে আমার মনে হয়েছিল, ওঁর (ধীরুভাই) দান নিতে পারব না।’’
ধীরুভাইয়ের সাহায্যে নিতে অস্বীকার করলেও পর্দার নায়কের মতোই নিজের জীবনে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন অমিতাভ। যশ চোপড়ার প্রযোজিত ‘মোহব্বতেঁ’ বক্স অফিসে বিপুল মুনাফা কামিয়েছিল। অমিতাভ বলেছিলেন, ‘‘দেউলিয়া হওয়ার পর ভাবতে বসেছিলাম, ‘কী কী করতে পারি আমি?’ নিজেকে বলেছিলাম, ‘আমি অভিনেতা। অভিনয়ই করব।’ সেটাই করেছিলাম।’’
ধীরে ধীরে ঋণের বোঝা নামিয়ে ফেলেছিলেন অমিতাভ। ‘মহব্বতেঁ’ ছাড়াও ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’-র মতো শোয়ের হাত ধরে কেটে ফেলেছিলেন ঋণের ফাঁদও।