টানা মাত্র তিন মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন। এর থেকে বেশি দাঁড়িয়ে থাকলেই তাঁর বিপদ। সারা দিনে অজ্ঞান হয়ে যান বার দশেক। কারণ আমেরিকার মেইনের ব্যাঙ্গোরের বাসিন্দা লিন্ডসে জনসন বিরল রোগের শিকার। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণেই এই বিরল রোগের শিকার লিন্ডসে। আজগুবি মনে হলেও এই ঘটনা সত্যি।
এক সময় দাপিয়ে বেড়ানো ২৮ বছর বয়সি লিন্ডসে রোগের তাড়নায় দিনের বেশির ভাগ সময়ই শয্যাশায়ী থাকেন। সারা দিনের যাবতীয় কাজে তাঁকে সাহায্য করেন তাঁর স্বামী। মূলত স্নান করার সময়ই বিছানা ছাড়েন লিন্ডসে। তবে স্নানও করতে হয় মেঝেতে বসেই।
কেন এমন অবস্থা হল লিন্ডসের? কেনই বা সারা দিনে ১০ বার জ্ঞান হারাতে হয় তাঁকে? কী সেই বিরল রোগ?
লিন্ডসে আসলে ‘পোস্টুরাল অর্থোস্ট্যাটিক টাকাইকার্ডিয়া সিন্ড্রোম’-এ আক্রান্ত।
‘পোস্টুরাল অর্থোস্ট্যাটিক টাকাইকার্ডিয়া সিন্ড্রোম’ আসলে কী? এই রোগে আক্রান্ত কোনও মানুষ দাঁড়িয়ে থাকলে তাঁর শরীরে রক্তের ঘনত্ব কমে যায়। শুয়ে থাকার পরে উঠে দাঁড়ালেই তাঁর মাথা ঘুরতে থাকে। সাধারণত ১৫ থেকে ৫০ বছর বয়সি মহিলাদের মধ্যেই এই রোগ বেশি দেখা যায়।
এই রোগের লক্ষণগুলি হল হালকা মাথাব্যথা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, হৃদ্স্পন্দন বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। বিছানায় শুয়ে থাকলে আবার সব ঠিক হয়ে যায়। খাদ্যে অতিরিক্ত লবণ যোগ করলে, বেশি করে তরল জাতীয় খাদ্য এবং ওষুধ খেলে লক্ষণগুলি কমতে পারে।
লিন্ডসে দাঁড়িয়ে থাকলে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে বাকিদের মতোই তাঁর শরীরের রক্তও পেট, হাত এবং পায়ের দিকে চলে আসে। স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহ বজায় রাখার জন্য এটি একটি স্বয়ংক্রিয় শারীরিক প্রক্রিয়া। কিন্তু লিন্ডসের জন্য তা স্বাভাবিক নয়।
রক্তচাপের আকস্মিক পরিবর্তনের ফলে এই রোগে আক্রান্তদের হৃদ্স্পন্দন দ্রুত বৃদ্ধি পায়। প্রতি মিনিটে হৃদ্স্পন্দন বাড়ে প্রায় ৩০ বার। এর ফলে বমি বমি ভাব এবং মাথা ঘোরা শুরু হয়। অনেকে জ্ঞান হারান।
এক সাক্ষাৎকারে লিন্ডসে বলেন, ‘‘আমার মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রতি অ্যালার্জি আছে। আমার কথা শুনে আমাকে পাগল মনে হলেও এই কথা সত্যি। আমি তিন মিনিটের বেশি দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। দিনে প্রায় ২৩ ঘণ্টা বিছানাতেই থাকি।’’
২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে লিন্ডসের হঠাৎই পেটে এবং পিঠে ব্যথা হতে শুরু করে। তখন তিনি নৌবাহিনীতে কাজ করতেন।
২০১৮ সালের মে মাস থেকে তাঁর শরীর আরও খারাপ হতে শুরু করে। এর পরই তিনি নৌবাহিনী থেকে অবসর নেন। চিকিৎসকেরা তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণ কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এই কারণে তাঁকে ঠিকমতো ওষুধও দিতে পারছিলেন না চিকিৎসকেরা।
সেই বছর থেকে তাঁর শরীরের অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। নিয়মিত ভাবে বমি হতে শুরু হয় লিন্ডসের। তাঁর সারা শরীরে এত ব্যাথা হত যে, তিনি যন্ত্রণায় চিৎকার করতেন। ঘন ঘন ‘অ্যানক্সাইটি অ্যাটাক’ও হতে শুরু করে লিন্ডসের।
যেখানে-সেখানে জ্ঞান হারাতেও শুরু করেন লিন্ডসে। ২০২০-তে তিনি হাসপাতালের লিফ্টে জ্ঞান হারান। সুপার মার্কেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে গিয়েও এক বার অজ্ঞান হয়ে যান। জ্ঞান হারাতেন পোষা কুকুরের চিৎকারেও।
এক চিকিৎসক লিন্ডসেকে ‘পোস্টুরাল অর্থোস্ট্যাটিক টাকাইকার্ডিয়া সিন্ড্রোম’ রোগের পরীক্ষা করাতে বলেন। তখনই বোঝা যায়, তিনি এই রোগে আক্রান্ত।
বর্তমানে চিকিৎসকদের পরামর্শে সঠিক ওষুধ খেয়ে এবং সঠিক ভাবে জীবনযাপন করে তিনি অনেকটাই সুস্থ। এখন আগের মতো দিনে ১০ বার জ্ঞান হারান না লিন্ডসে। এই সংখ্যা কমে হয়েছে দু’-তিন বার। তবে তিনি এখনও নিজে কিছু করতে পারেন না। সমস্ত কাজে স্বামী জেমসই তাঁকে সাহায্য করেন।
‘পোস্টুরাল অর্থোস্ট্যাটিক টাকাইকার্ডিয়া সিন্ড্রোম’-এর লক্ষণগুলির সঙ্গে অন্য এত রোগের লক্ষণের সাযুজ্য আছে যে, চট করে এই রোগ নির্ণয় করা চিকিৎসকদের জন্যও কঠিন।
ঠিক কী কারণে এই রোগ হয়, তা এখনও চিকিৎসকদের অজানা। তবে গুরুতর অসুস্থতা, গভীর আঘাত থেকে বা গর্ভধারণ করার পর এই রোগ শরীরে দেখা দিতে পারে। এ ছাড়াও ক্যানসার, মধুমেহ, অতিরিক্ত মদ্যপান বা ধাতব বিষক্রিয়ার কারণেও এই রোগ শরীরে দেখা দিতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে এই রোগ অল্প দিনের জন্য দেখা গেলেও অনেকের ক্ষেত্রে এর প্রভাব থাকে দীর্ঘ দিন।