বিরল রোগে আক্রান্ত ছিলেন আমেরিকার ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের সেন্ট থমাস দ্বীপের বাসিন্দা হ্যানা উপ। প্রায় ৬ বছর আগে হঠাৎ করেই এক দিন বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে যান তিনি। তবে রাতারাতি ‘উবে’ যাওয়ার আগে কোথায় যেতে পারেন, তার কিছু সূত্র তিনি রেখে গিয়েছিলেন।
৩২ বছর বয়সি হ্যানা পেশায় এক জন শিক্ষক ছিলেন। বছর ছয়েক আগে সেন্ট টমাস দ্বীপে তাঁর আবাসনে শেষ বারের মতো দেখা গিয়েছিল হ্যানাকে।
হ্যানা ‘উবে’ যাওয়ার পর তাঁর বাড়ি থেকে একটি চিরকুট খুঁজে পেয়েছিল পুলিশ। তদন্তে নেমে উদ্ধার হয় হ্যানার ব্যবহার করা কিছু জিনিসপত্রও। আর তা দেখেই অনেকে অনুমান করেছেন, কোথায় খুঁজে পাওয়া যেতে পারে তাঁকে।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হ্যারিকেন ঘূর্ণিঝড় ‘ইরমা’র তাণ্ডবে আমেরিকায় ১০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিলেন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সেন্ট টমাস দ্বীপপুঞ্জেও। ইরমা আছড়ে পড়ার পরই হ্যানা নিখোঁজ হন।
ইরমার হাত থেকে বাঁচতে হ্যানা তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে আবাসনের কাপড় কাচার ঘরে গিয়ে আশ্রয় নেন। হ্যানার ওই বন্ধু জানতেন না যে, হ্যানা বিরল রোগে আক্রান্ত। যা পরিচিত ‘ডিসোসিয়েটিভ ফুগ’ বা ‘জেসন বোর্ন সিনড্রোম’ নামেও।
ঝড়ের সময় বিশেষ কারণে হ্যানার ওই বন্ধু এক বারের জন্য কাপড় কাচার ঘর থেকে বাইরে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে তিনি দেখেন, হ্যানা আর ওখানে নেই। এর পর থেকে হ্যানাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
২০০২ সালের বিখ্যাত হলিউড ছবি ‘জেসন বোর্ন’ ছবির নায়কের মতোই হ্যানার মাঝেমধ্যেই স্মৃতিভ্রম হত। বেশ কিছু দিন পর পর ফিরে আসত পুরনো স্মৃতি। স্মৃতিভ্রম হলে নিজের নাম, ধাম, পরিচয় সবই ভুলে যেতেন তিনি।
বেশ কয়েক জন চিকিৎসকদের মতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে হ্যানার মানসিক চাপ তৈরি হয়েছিল। আর সেই চাপের কারণেই তাঁর স্মৃতিভ্রম হয় এবং তিনি দুর্যোগের মধ্যেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।
২০১৭ সালের আগেও এই ধরনের স্মৃতিভ্রম হয়েছিল হ্যানার। ২০০৮ সালে নিউ ইয়র্কে তিন সপ্তাহের জন্য নিজের স্মৃতি হারিয়ে ফেলেন তিনি। যদিও পরে তিনি সেই স্মৃতি ফিরে পান।
এর পর ২০১০ সালে মেরিল্যান্ডের কেনসিংটনে এক বার স্মৃতিভ্রম হয়েছিল হ্যানার। তখন তিনি কর্মসূত্রে কেনসিংটনেই থাকতেন। প্রায় দু’দিন পর স্মৃতি ফিরে পান হ্যানা। স্মৃতি ফেরার পর দেখেন তিনি একটি নালায় পড়ে রয়েছেন।
কিন্তু ২০১৭ সালে নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে হ্যানাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরিবারের অভিযোগের পর সদলবলে হান্নার খোঁজে নামেন সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞ আধিকারিক জ্যাক ব্র্যাডলি। অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে খুঁজে পাননি জ্যাক। তবে হ্যানার নিখোঁজ হওয়ার পিছনে জ্যাকের কিছু নিজস্ব তত্ত্ব ছিল।
হ্যানা নিখোঁজ হওয়ার পর তাঁর বাড়ি থেকে যে চিরকুট পাওয়া গিয়েছিল তা তিনি নিজের বন্ধুর উদ্দেশে লিখে রেখে গিয়েছিলেন। হ্যানার বন্ধু তাঁর সঙ্গে একই ঘরেই থাকতেন।
ওই চিরকুটে লেখা ছিল, স্যাফায়ার সমুদ্রসৈকতে সকাল সকাল সাঁতার কাটতে যেতে চান হ্যানা। স্নান সেরে তিনি কাজে যেতে চান বলেও লেখা ছিল ওই চিঠিতে।
চিঠি পেয়েই ওই সমুদ্রসৈকতে খোঁজ চালানো হয়। সেখানে গিয়ে তদন্তকারীরা হ্যানার একটি পোশাক, এক জোড়া জুতো এবং তাঁর গাড়ির চাবি বালি থেকে উদ্ধার করেন।
কয়েক জন প্রত্যক্ষদর্শীর মতে ঝড়ের সময় হ্যানাকে সমুদ্রসৈকতের কাছাকাছি দেখেছিলেন তাঁরা। তবে হ্যানা তখন স্বাভাবিক আচরণ করছিলেন না বলেও তাঁরা দাবি করেন।
জ্যাকের দৃঢ় ধারণা দুর্যোগের সময় সমুদ্রে সাঁতার কাটতে চলে গিয়েছিলেন হ্যানা। এক সংবাদমাধ্যমে জ্যাক বলেছিলেন, ‘‘এটা পরিষ্কার যে হ্যানা বিভ্রান্ত হয়ে সাঁতার কাটতে সমুদ্রের জলে নামেন। আর ফিরে আসতে পারেনি।’’
উত্তাল ঢেউ হ্যানাকে সমুদ্রগর্ভে টেনে নিয়েছিল বলে দাবি করেন জ্যাক। তিনি এ-ও দাবি করেন, সেই সময় সমুদ্র এমন উত্তাল হয়ে উঠেছিল যে, এক জন বাঘা সাঁতারুরও সেই স্রোতে সাঁতার কাটা বেশ কঠিন ছিল।
তবে জ্যাকের তত্ত্ব মেনে নিতে রাজি ছিলেন না হ্যানার পরিবার। তাঁদের দাবি ছিল, দুর্যোগের আড়ালে কেউ হ্যানাকে খুন করেন এবং তাঁর কিছু পোশাক সমুদ্রসৈকতে ফেলে দিয়ে আসেন। অনেকে আবার দাবি করেছিলেন, হ্যানার ওই আবাসনের কাপড় কাচার ঘরে থাকা কোনও অশরীরী প্রাণ কেড়েছে তাঁর।
হ্যানার অন্তর্ধানের আরও একটি ব্যাখ্যা প্রকাশ্যে এসেছিল। সেন্ট টমাস দ্বীপের কয়েক জন পুলিশের দাবি ছিল, দুর্যোগকে ঢাল বানিয়ে নিজেই ঘর ছাড়েন হ্যানা। তাঁদের দাবি হ্যানা এখনও বহাল তবিয়তে আছেন এবং অন্য কোনও জায়গায় বসবাস করছেন।
যদিও সেই জল্পনার ভিত্তিতে খোঁজাখুজি করেও লাভ হয়নি। অমীমাংসিতই থেকে গিয়েছে হ্যানা অন্তর্ধান রহস্য।