১৯১১ সালের ২১ অগস্টের ঘটনা। সোমবার সকালে প্যারিসের ল্যুভর মিউজ়িয়মের সামনে ৩ জন দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এক পলক দেখলে মনে হবে, তাঁরা জাদুঘরেরই কর্মী। তাঁদের পরনেও রয়েছে কর্মীদের পোশাক। কর্মীরা যে দরজা দিয়ে জাদুঘরের ভিতরে প্রবেশ করেন, সেই দরজা খুলে দেওয়া হল। কর্মীরা একের পর এক জাদুঘরে প্রবেশ করলেন। সেই ভিড়ে মিশে গেলেন ওই ৩ জন। জাদুঘরের ভিতরে ঢুকে পড়লেন তাঁরা। কিন্তু তার পরেই এমন এক ঘটনা ঘটল, যা বিশ্ব ইতিহাসে এক অন্ধকার অধ্যায় তৈরি করেছে। সবার সামনেই মোনালিসার ছবি চুরি করা হয়েছিল সে দিন। নারায়ণ সান্যালের লেখা ‘প্রবঞ্চক’ উপন্যাসে এই ঘটনার আভাসও রয়েছে।
ভিনসেনজো পেরুজিয়া। ১৮৮১ সালে ইটালিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। মোনালিসা চুরির ঘটনার সঙ্গে ভিনসেনজোর নাম ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। দেশভক্তির জন্যই নাকি ছবিটি চুরি করেছিলেন ভিনসেনজো। তাঁকে সাহায্য করেছিলেন এডুয়ার্ডো দে ভ্যালফিয়ের্নো এবং ইয়েভস চড্রন।
ভ্যালফিয়ের্নোর পরিকল্পনা অনুযায়ী, মোনালিসার কয়েকটি নকল ছবি এঁকেছিলেন ইয়েভস। তার মধ্যে একটি জাদুঘরের আসল ছবির বদলে রেখে বাকি ছবিগুলি আসল হিসাবে চড়া দামে বিক্রি করার পরিকল্পনা ছিল তাঁদের। সোমবার সকালে জাদুঘরে ঢুকে মোনালিসা চুরি করেন ওই ৩ জন।
ল্যুভর জাদুঘরের যে ঘরে মোনালিসার ছবিটি টাঙানো ছিল, সেই ঘরটি ফাঁকা হলে সুযোগ বুঝে চুরি করে পালিয়ে যান ভিনসেনজো, ভ্যালফিয়ের্নো এবং ইয়েভস। পুলিশ পরে জানিয়েছিল, জাদুঘরের পিছনের সিঁড়ি দিয়ে সকলের অলক্ষে পালিয়ে যান তাঁরা। অন্য একটি মতে, সবার সামনে দিয়েই ছবিটি নিয়ে চলে যান ভিনসেনজোরা।
চুরি করার পর ছবিটি নিয়ে প্যারিসে নিজের বাড়িতে চলে আসেন ভিনসেনজো। কোটি কোটি ডলারের সেই ছবি দু’বছর বাড়িতে একটি ট্রাঙ্কের ভিতর রেখে দেন তিনি। চুরি করার ৪ মাস পর ভিনসেনজো তাঁর বাবাকে একটি চিঠিতে লিখে বলেন যে, ‘‘আমি এক লহমায় নিজের ভাগ্য তৈরি করব।’’ ১৯১২ সালে আরও একটি চিঠিতে তিনি তাঁর বাবাকে লেখেন, ‘‘আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমি যা উপহার দেব তাতে আমাদের পরিবার বহু বছর ভাল করে কাটাতে পারবে।’’
মোনালিসার ছবি নিয়ে প্যারিস থেকে ইটালি আসেন ভিনসেনজো। ইটালির ফ্লোরেন্সের একটি আর্ট গ্যালারির মালিক মারিয়ো ফ্রাটেলির সঙ্গে যোগাযোগ করেন ভিনসেনজো। মোনালিসার ছবিটি মারিয়োকে বিক্রি করতে চান তিনি। নকল কি না তা নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় উফিজি গ্যালারির ডিরেক্টর জিওভানি পোগির সাহায্য চান মারিয়ো।
জিওভানি জানান যে, এটিই মোনালিসার আসল ছবি। তার পর পুলিশের কাছে ভিনসেনজোর বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ দায়ের করেন মারিয়ো এবং জিওভানি। জেরায় পুলিশকে ভিনসেনজো জানিয়েছিলেন তিনি কী ভাবে চুরি করেছিলেন। ভিনসেনজোর দাবি, চুরি করার পর কী ভাবে মোনালিসার ছবি বাইরে নিয়ে যাবেন তা বুঝতে পারছিলেন না।
নিজের জামার ভিতরে লুকোনোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন ভিনসেনজো। পরে তিনি ছবিটি নিজের জামা দিয়ে ভাল করে মুড়ে ফেলেন এবং জাদুঘর থেকে বেরিয়ে যান। তবুও পুলিশের ধারণা, সোমবার সকাল নয়, বরং রবিবার রাতে জাদুঘরের ভিতরে লুকিয়েছিলেন ভিনসেনজো। পরের দিন সকালে জাদুঘরের দরজা খুললে তিনি চুরি করে বেরিয়ে যান।
পুলিশের কাছে চুরির কথা স্বীকার করার পর ভিনসেনজোকে ১ বছর ১৫ দিনের জন্য জেল খাটার নির্দেশ দেওয়া হয়। আদালতে ভিনসেনজো নিজেকে ‘দেশপ্রেমিক’ বলে দাবি করেন। মোনালিসার ছবি ইটালি থেকে ল্যুভর জাদুঘরে লুট করে নিয়ে আসা হয়েছে বলেও দাবি করেন।
তাই চুরি করে ইটালির জিনিস ইটালিতেই ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছিলেন ভিনসেনজো। পরে অবশ্য তাঁর মাথায় ছবিটি চড়া দামে বিক্রি করার ভাবনা আসে। দেশভক্তির জন্য চুরি করেছিলেন বলে অবশ্য ভিনসেনজোর সাজা কমিয়ে দেওয়া হয়।
সাত মাস জেল খাটার পর ছাড়া পান তিনি। কিন্তু এখনও অনেকের অনুমান যে, ল্যুভর জাদুঘরে মোনালিসার নকল ছবি রয়েছে। আসল ছবি বিক্রি করে দিয়েছেন ভিনসেনজোরা।
জেল থেকে যখন ভিনসেনজো বেরিয়ে আসেন তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। সেই সময় ইটালির সেনাদলে যুক্ত হন ভিনসেনজো। যুদ্ধ চলাকালীন অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সৈন্যরা ভিনসেনজোকে বন্দি বানিয়ে ফেলেন। যুদ্ধশেষে ভিনসেনজোকে মুক্তও করে দেওয়া হয়।
মুক্তি পাওয়ার পর বাড়ি ফিরে আসেন ভিনসেনজো। স্ত্রী এবং কন্যাসন্তান-সহ দিনযাপন করতে থাকেন তিনি। পরবর্তী কালে পিয়েট্রো পেরুজিয়া নামে চিত্রশিল্পী হিসাবে কাজ করতেন ভিনসেনজো।
১৯২৫ সালের ৮ অক্টোবর ৪৪ বছর বয়সে মারা যান ভিনসেনজো। প্যারিসের সেন্ট মর দেস ফসেস এলাকায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে আসে ১৯৪৭ সালে। ভিনসেনজো পেরুজিয়া নামে এক জন ১৯৪৭ সালে মারা যান। সেই সময় জানা যায়, মৃত্যুর সময় ভিনসেনজোর সমাধির উপর পিয়েট্রো নাম লেখা ছিল। ১৯৫০ সালে ভিনসেনজোর দেহাবশেষ সরিয়ে দেওয়া হয় বলে জানা যায়।
১৯৩২ সালে কার্ল ডেকার নামে এক সাংবাদিক দাবি করেন যে, তিনি মোনালিসা চুরির ঘটনার সঙ্গে যু্ক্ত এডুয়ার্ডো দে ভ্যালফিয়ের্নোকে চিনতেন। এডুয়ার্ডো তাঁর কাছে স্বীকার করেছিলেন যে, মোনালিসার নকল ছবিগুলি তিনি নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। চুরির খবর রটে যাওয়ার পর তিনি সেই সুযোগের ব্যবহার করতেন। নকল ছবি আসল বলে চড়া দামে বিক্রি করার চিন্তাভাবনা করেছিলেন এডুয়ার্ডো। অবশ্য তিনি যত দিন বেঁচেছিলেন তত দিন এই কথা সংবাদপত্রে ছাপাতে বারণ করেছিলেন এডুয়ার্ডো। তিনি মারা যাওয়ার পর কার্ল তা প্রকাশ্যে আনেন।
তবে এখন আসল মোনালিসার ছবি কোথায় রয়েছে তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। ষোড়শ শতকে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির সৃষ্টি এখনও ল্যুভর জাদুঘরের অন্দরে রয়েছে বলে অনেকের দাবি। আবার সমালোচক মহলের একটি অংশ মনে করেন, জাদুঘরের ভিতর নকল ছবি রয়েছে। ভিনসেনজোর মৃত্যুর সঙ্গে এই রহস্যের সমাধান হারিয়ে গিয়েছে।