৬৭ বছর বয়সে ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হল বর্ষীয়ান অভিনেতা নঈম সৈয়দের। চলচ্চিত্র জগৎ জুড়ে যিনি পরিচিত ছিলেন ‘জুনিয়র মেহমুদ’ নামে। দীর্ঘ দিন ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করছিলেন তিনি। বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। বাড়িতেই মৃত্যু হয় তাঁর।
নঈমের চলাফেরা বা কথাবার্তায় বলিউডের বিখ্যাত কৌতুকাভিনেতা মেহমুদের সঙ্গে হুবহু মিল ছিল। সকলের কাছ থেকেই প্রশংসা হিসাবে সে কথা শুনতেন তিনি। সেই মেহমুদই নঈমের নাম ‘জুনিয়র মেহমুদ’ রেখেছিলেন।
১৯৫৬ সালের ১৫ নভেম্বর বাণিজ্যনগরী মুম্বইয়ে নঈমের জন্ম। স্কুলে পড়াশোনা করার সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অভিনয় করতেন নঈম। বিভিন্ন অভিনেতাকে অনুকরণ করতেন ছোটবেলা থেকেই।
নঈমের দাদা সিনেমার সেটে ছবি তুলতেন। তাই ছোটবেলা থেকেই ছবির সেটে যাতায়াত ছিল তাঁর। এক দিন দাদার সঙ্গে হিন্দি ছবি ‘কিতনা নাজ়ুক হ্যায় দিল’-এর সেটে গিয়েছিলেন নঈম। সেখানে এক শিশুশিল্পী অভিনয় করতে গিয়ে হোঁচট খাওয়ায় তাকে নিয়ে হাসাহাসি করেন নঈম।
এর পর পরিচালক রেগে গিয়ে নঈমকে অভিনয় করে দেখাতে বলেন। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান নঈম। গড়গড় করে সংলাপ বলে দেন। তেমনই হাত-পা নেড়ে অভিনয়। নঈমকে পছন্দ হয়ে যায় পরিচালকের। কিন্তু কোনও কারণে সেই ছবি মুক্তি পায়নি।
১৯৬৭ সালে সঞ্জীব কুমার, বলরাজ সাহানী এবং ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায় অভিনীত ‘নৌনিহাল’ ছবিতে শিশু অভিনেতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন নঈম। ছবিতে ‘বিলু’ নামে একটি চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। শিশু কৌতুক অভিনেতা হিসাবে বিস্তর জনপ্রিয়তাও পেয়েছিলেন। সেই সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৯ বছর।
পরের বছর হিন্দি রোম্যান্টিক ছবি ‘সুহাগ রাত’-এ অভিনয় করে বিস্তর প্রশংসা কুড়িয়েছিল। এর পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। একের পর এক নামীদামি ছবিতে অভিনয় করতে থাকেন তিনি। নায়ক-নায়িকা বদল হলেও নঈমের জায়গা ছিল পাকা।
বিখ্যাত ভারতীয় অভিনেতা মেহমুদ আলি, নঈমকে ‘মেহমুদ জুনিয়র’ নাম দিয়েছিলেন। ‘সুহাগ রাত’ ছবির শুটিং চলাকালীন মেহমুদ এবং নঈমের প্রথম সাক্ষাৎ হয়। ভাল সম্পর্ক তৈরি হলেও মেহমুদের মেয়ের জন্মদিনের পার্টিতে আমন্ত্রণ পাননি নঈম।
এর পর নঈম সটান মেহমুদের কাছে পৌঁছে যান এবং তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর অনুরোধ করেন। নঈম এ-ও প্রতিশ্রুতি দেন যে, সবাই যাতে পার্টি উপভোগ করেন, তা তিনি নিশ্চিত করবেন।
পার্টিতে মেহমুদ আলির বিখ্যাত গান ‘হাম কালে হ্যায় তো কেয়া হুয়া দিলওয়ালে হ্যায়’ গানে নেচে দেখান নঈম। পার্টিতে হাততালির বন্যা বয়ে যায়। পর দিনই নঈমকে রঞ্জিত স্টুডিয়োতে ডেকে পাঠান মেহমুদ। তাঁকে শিষ্য হিসাবে মেনে নেন। বিনিময়ে গুরুকে দক্ষিণা হিসাবে ২৫ পয়সা দেন নঈম।
৭০-এর দশকে মেহমুদ জুনিয়র তাঁর কেরিয়ারের শীর্ষে ছিলেন। শিশুশিল্পী হিসাবে অভিনয় করেই মুম্বইয়ের বুকে বিলাসবহুল বাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন। সেই সময়ে মুম্বইতে যে ১২টি বিদেশি গাড়ি ছিল তার একটির মালিক ছিলেন নঈম।
শিশুশিল্পী হিসাবে অনেক বড় বড় অভিনেতার থেকে বেশি পারিশ্রমিক পেতেন তিনি।
তবে যৌবনের দিকে নঈম যত পা বাড়াতে থাকেন, তত তাঁর কাছে ছবির প্রস্তাব আসা কমে যেতে থাকে। ছোটখাট চরিত্রে অভিনয় করার ডাক পেতে থাকেন। ২০০২ সালে বলিউডের মজার ছবি ‘চলো ইশক লড়ায়ে’-তে চাকরের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন নঈম।
অভিনয়ের পাশাপাশি ছবি পরিচালনার দিকেও ঝুঁকেছিলেন জুনিয়র মেহমুদ। ‘মসকরি’, ‘পাগলপন’, ‘কর্মযোগ’, এবং ‘তুলাস আলি ঘর’-সহ বেশ কয়েকটি মরাঠি ছবির পরিচালনা করেন তিনি। ছবিগুলি প্রযোজনার দায়িত্বও তাঁরই ছিল।
২০১২ সালে জনপ্রিয় হিন্দি সিরিয়াল ‘পেয়ার কা দর্দ হ্যায় মিঠা মিঠা পেয়ারা পেয়ারা’-র মাধ্যমে টেলি দুনিয়ায় প্রবেশ করেন তিনি। কৌতুক অভিনেতা হিসাবে দেশের পাশাপাশি বিদেশের মাটিতে বহু অনুষ্ঠানও করতেন জুনিয়র মেহমুদ।
পাঁচ দশকের অভিনয় জীবনে ২৫০টিরও বেশি ছবিতে কাজ করেছিলেন নঈম। এর মধ্যে ‘কাটি পতঙ্গ’, ‘মেরা নাম জোকার’, ‘পরওয়ারিশ’, এবং ‘দো অর দো পাঁচ’-এর মতো বহু সফল ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। দর্শকদের কাছেও জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। ‘ঘর ঘর কি কহানি’-র জন্য জাতীয় পুরস্কারের জন্যও মনোনীত হয়েছিলেন নঈম।
মৃত্যুর আগে বর্ষীয়ান অভিনেতা জিতেন্দ্র এবং সচিন পিলগাঁওকরের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন নঈম। জিতেন্দ্র এবং সচিনের সঙ্গে বেশ কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি। দু’জনেই ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দু’জনেই তাঁর সঙ্গে দেখা করে আসেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন কৌতুক অভিনেতা তথা বন্ধু জনি লিভারও। সপ্তাহ দুয়েক আগে নঈমের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।