১৯৮৯ সালের ১১ নভেম্বর। রানিগঞ্জের মহাবীর কয়লাখনিতে ঘটা ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনার স্মৃতি এখনও অনেক ভারতবাসীর মনে জ্বলজ্বল করছে। রানিগঞ্জের মানুষ ভোলেননি সেই সময় খনির ইঞ্জিনিয়ার পদে কর্তব্যরত যশবন্ত সিংহ গিলের সাহসিকতা এবং বীরত্বের কাহিনি। একা হাতে বহু খনি শ্রমিকের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন তিনি।
১৬ নভেম্বর ভোরবেলা রানিগঞ্জের মহাবীর খনিতে আটকে থাকা ৬৫ জন শ্রমিককে অভিনব উপায়ে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছিল। অভিযানের নেপথ্যনায়ক ছিলেন যশবন্ত।
রানিগঞ্জে ১৯৮৯ সালের সেই ঘটনার ৩৪ বছর পেরিয়েছে। এ বার বাস্তবের সেই ঘটনা পর্দায় ফিরছে অক্ষয় কুমারের হাত ধরে। ‘মিশন রানিগঞ্জ’ নামের সেই ছবি অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়ার কথা।
ছবিটিতে যশবন্তের চরিত্রে অভিনয় করছেন অক্ষয়। পঞ্জাবি যশবন্তের চরিত্রে তাঁকে দিব্যি মানিয়েছে বলে দাবি। এই ছবির শুটিং মূলত হয়েছে রানিগঞ্জ-আসানসোল-দুর্গাপুর কয়লাঞ্চলে।
কিন্তু ১৯৮৯ সালের নভেম্বর মাসে মহাবীর কয়লাখনিতে ঠিক কী ঘটেছিল তা এখনও অনেকেরই অজানা। যদিও রানিগঞ্জের বহু মানুষের মনে সেই স্মৃতি তাজা।
১১ নভেম্বর গভীর রাতে মহাবীর খনির ২১ এবং ৪২ নম্বর সেকশনে কয়লা কাটার কাজ চলছিল। বেশ কয়েক জন শ্রমিক খনি থেকে উঠে এলেও ২১ নম্বরে ৬১ জন এবং ৪১ নম্বরে ১০ জন শ্রমিক কাজ করছিলেন।
সবাই উঠে এসেছে মনে করে কয়লা উত্তোলনের জন্য খনিতে বিস্ফোরণ ঘটানো শুরু হয়। আর তার ফলেই ঘটে বিপত্তি। বিস্ফোরণে খনির দেওয়ালে ফাটল ধরে যায়। ব্রিটিশ আমলের সেই দেওয়ালের পাশেই ছিল পুরনো খনির জমা জল।
খনির পুরনো দেওয়াল ফেটে প্রায় ১১ লক্ষ গ্যালন জল মহাবীর খনিতে ঢুকে পড়ে। প্রায় ২০০ জন উপরে উঠে এলেও, খনির ভিতর আটকে পড়েন ৭১ জন শ্রমিক। তাঁদের মধ্যে ৬ জন জলের তোড়ে ভেসে যান। পরে তাঁদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল।
বাকি ৬৫ জন প্রাণ বাঁচাতে খনির ভিতরের একটি উঁচু জায়গায় কোনও রকমে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তার মধ্যেই খনির ভিতরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এমন অবস্থা হয়েছিল যে পাশে কে দাঁড়িয়ে আছেন, তা-ও বুঝতে পাচ্ছিলেন না খনির শ্রমিকরা। অন্ধকারের মধ্যে একে অপরকে জাপটে ধরে দাঁড়িয়েছিলেন।
খাবার, পানীয় জল ছাড়া খনির ভিতরে আটকে পড়েছিলেন ৬৫ জন শ্রমিক। মৃত্যুর চিন্তাও গ্রাস করে অনেককে। তবে কয়েক জন সাহস হারাননি।
অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে খনির ভিতরের টেলিফোন পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিলেন তাঁরা। সেই ফোনের সাহায্যেই কোনও রকমে জানিয়েছিলেন নিজেদের আটকে থাকার কথা।
মাটির তলায় ওই ৬৫ জন কর্মী ঠিক কোথায় আটকে রয়েছেন, তা কিছু ক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পেরে যান ইসিএলের দক্ষ আধিকারিকরা। মাটির উপর থেকেই স্থানটিকে খুঁজে বার করেন নির্ভুল ভাবে।
এর পরেও বেশ কয়েক ঘণ্টা খনির ভিতরেই আটকে থাকতে হয়েছিল ওই ৬৫ জন শ্রমিককে। ১৩ নভেম্বর খনিতে প্রথম গর্ত বা বোর হোল করা হয়। তা দিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন ইসিএল কর্তারা। পাঠানো হয় খাবার ও জল। ধানবাদ থেকে বিশেষ উদ্ধারকারী দলও ডেকে পাঠানো হয়।
তবে খনিতে জল ভরে থাকায় এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় আটকে থাকা শ্রমিকদের কী ভাবে উদ্ধার করা হবে, তা নিয়ে ইসিএল আধিকারিকদের মনে সংশয় দেখা যায়।
অন্য দিকে খনিতে আটকে থাকা শ্রমিকদের পরিবারের লোকেরাও তত ক্ষণে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছেন। তখনই খনি শ্রমিকদের ত্রাতা হয়ে এগিয়ে আসেন খনির চিফ মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার যশবন্ত।
যশবন্ত দেখেন, বোর হোলের মাধ্যমে ক্যাপসুল জাতীয় কোনও জিনিস ঢুকিয়ে শ্রমিকদের উদ্ধার করা সম্ভব। সেই মতো ইসিএলের কুলটির নিয়ামতপুরের ওয়ার্কশপে ১৪ নভেম্বর তড়িঘড়ি লোহার চাদর দিয়ে মানুষের শরীরে সমান ক্যাপসুল তৈরি হয়ে যায়। এর পর ১৯৮৯ সালে ১৫ নভেম্বর আটকে থাকা শ্রমিকদের উদ্ধার করতে রাতভর লড়াই শুরু করেন যশবন্ত এবং তাঁর সহকর্মীরা।
১৫ নভেম্বর রাত থেকেই হাজার হাজার লোক জমা হতে শুরু করেন রানিগঞ্জের নারায়ণকুড়ি এলাকায়। ক্যাপসুল তৈরি হয়ে গেলেও খনির নীচে কে নামবে? বোর হোলের মধ্যে ক্যাপসুল আটকে যেতে পারে এই ভয়ে অনেকেই নামতে রাজি হননি। খনির ভিতরে বিপজ্জনক গ্যাস থাকারও আশঙ্কা ছিল। তখন যশবন্ত ঠিক করেন, তিনি নিজেই নীচে নামবেন। বন্ডে সই করে ক্যাপসুলে করে নীচে নামেন তিনি।
যশবন্তের চেষ্টায় একে একে ৬৫ জন শ্রমিকই উপরে উঠে আসতে সক্ষম হন। সবাইকে উদ্ধার করে ১৬ নভেম্বর ভোরে নিজে উঠে আসেন যশবন্ত। এই খবর প্রকাশ্যে আসার পর সারা দেশে তোলপাড় পড়ে যায়।
পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এসে যশবন্তকে শুভেচ্ছা জানিয়ে গিয়েছিলেন। তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি ভেঙ্কটরমনও তাঁকে সর্বোত্তম জীবন রক্ষা পদক পুরস্কারে সম্মানিত করেন। তবে ওই দুর্ঘটনার পর থেকেই মহাবীর খনির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
১৯৩৯ সালের ২২ নভেম্বর পঞ্জাবের অমৃতসরে যশবন্তের জন্ম। ২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর ২০১৯ হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে পঞ্জাবেই তাঁর মৃত্যু হয়। সেই ঘটনা নিয়েই তৈরি হয়েছে ‘মিশন রানিগঞ্জ’। ছবিটিতে অক্ষয় ছাড়াও রয়েছেন অভিনেত্রী পরিনীতি চোপড়া। যশবন্তের স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। ছবির পরিচালনা করেছেন টিনু সুরেশ দেশাই।
কোলিয়ারির জেনেরাল ম্যানেজার অনিলকুমার সিন্হার অনুমতি নিয়ে এই ছবিতে খনির কর্মীরাও অভিনয় করেছেন। বাঁশরা হাসপাতালে চিকিৎসকদের ভূমিকায় কাজ করেছেন তাঁরা। সকলেই ছবি মুক্তির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।